সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার বা তওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া

FB_IMG_1502477883614

সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার বা তওবার শ্রেষ্ঠ দোয়া

যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সন্ধ্যায় সায়্যিদুল ইস্তিগফার পড়ে সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায়, তবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সহিহ বোখারি: ৬৩০৬

নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালে সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে যদি সন্ধ্যা হওয়ার আগে মারা যায় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালে সায়্যিদুল ইস্তিগফার পাঠ করবে, সে যদি সন্ধ্যা হওয়ার আগে মারা যায় তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি সুদৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সন্ধ্যায় সায়্যিদুল ইস্তিগফার পড়ে সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায়, তবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -সহিহ বোখারি: ৬৩০৬

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা। খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা। ওয়া আনা আলা আহদিকা। ওয়া ওয়া’দিকা মাসতাতা’তু। আউজু বিকা মিন শাররি মা-সানা’তু। আবুয়ু লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা। ওয়া আবুয়ু লাকা বি জাম্বি। ফাগফিরলী। ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনবা ইল্লা আনতা।

অর্থ : হে আল্লাহ! একমাত্র আপনিই আমাদের প্রতিপালক। আপনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। আপনিই আমার স্রষ্টা এবং আমি আপনার দাস। আমি আপনার সঙ্গে কৃত ওয়াদা ও অঙ্গীকারের ওপর সাধ্যানুযায়ী অটল ও অবিচল আছি। আমি আমার কৃতকর্মের সব অনিষ্ট হতে আপানার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমার উওর আপনার দানকৃত সব নেয়ামত স্বীকার করছি। আমি আমার সব গুনাহ স্বীকার করছি। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। কেননা, আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া” Al Bidaya Wal Nihaya

FB_IMG_1508977780594

আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া” Al Bidaya Wal Nihaya প্রখ্যাত মুফাসসির ও ইতিহাসবেত্তা আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ) প্রণীত একটি সুবৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থ। এই গ্রন্থের সৃষ্টির শুরু তথা আরশ, কুরসী, নভোমন্ডল, ভূমন্ডল প্রভৃতি এবং সৃষ্টির শেষ তথা হাশর-নশর, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম প্রভৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

এই গ্রন্থটি ১৪টি খন্ডে সমাপ্ত হয়েছে। আল্লামা ইবনে কাসীর (র) তাঁর এই গ্রন্থকে তিনভাগে ভাগ করেছেন।

প্রথম ভাগ: আরশ, কুরসী, ভুমন্ডল, নভোমন্ডল এতদুভয়ের অন্তর্বতী সব কিচু তথা ফেরেশতা, জিন, শয়তান, আদম (আ)-এর সৃষ্টি, যুগে যুগে আবির্ভূত নবী-রাসুলগণের ঘটনা, বনী ইসরাঈল, ইসলাম-পূর্ব যুগের রচনাবলী এবং মুহাম্মাদ (সা)-এর জীবন-চরিত আলোচনা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় ভাগ : রাসুল (সা)-এর ওফাতকাল থেকে ৭৬৮ হিজরী সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ কালের বিভিন্ন ঘটনা এবং মনীষীদের জীবনী আলোচনা করা হয়েছে।

তৃতীয়ভাগ : ফিতনা-ফাসাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, কিয়ামতের আলামত, নাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নামের বিবরণ ইত্যাদি।

লেখক তাঁর এই গ্রন্থের প্রতিটি আলোচনা কুরআন, হাদীস, সাহাবাগণের বর্ণনা, তাবেঈন ও অন্যান্য মনীষীদের দ্বারা সমৃদ্ধ করেছেন। ইবনে হাজার আসাকালানী (রহ), ইবনুল ইমাদ আল-হাম্বলী (র) প্রমুখ ইতিহাসবিদ এই গ্রন্থের প্রশংসা করেছেন। বদরুদ্দীন আইনী হানাফী (র) এবং ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) গ্রন্থটির সার-সংক্ষেপ রচনা করেছেন।

বিখ্যাত এই গ্রন্থটির ১-১০ খন্ড অনুবাদ প্রকাশ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

১-৭ ও ৯ম খন্ড স্ক্যান করেছে ইসলামী বই ডট ওয়ার্ডপ্রেস ডট কম এবং ৮ম ও ১০ম খন্ড স্ক্যান এবং সম্পূর্ণ বইটিতে Interactive Link অ্যাড করেছে waytojannah.com । যারা এই কাজে পরিশ্রম ব্যয় করেছেন, আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

নতুন সংস্করণে Interactive Link অ্যাড করা হয়েছে ।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

ইবনে খালদুন

download (1)

ইবনে খালদুন
মুসলিম দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির প্রতিষ্ঠাতা ইবনে খালদুন ১৪০৬ সালের ১৯ মার্চ (৮০৮ হিজরি) মৃত্যুবরণ করেন। ‘আল মুকাদ্দিমা’ তার রচিত বিখ্যাত বই। সপ্তদশ শতকের উসমানীয় খলিফাদের ওপর তার এই বইয়ের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। এ ছাড়া আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের পথিকৃত বলা হয় তাকে।

খালদুনের পুরো নাম ওয়ালি উদ্দিন আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ। তিনি তিউনিসে আরব বংশোদ্ভূত আন্দালুসিয়ান এক অভিজাত পরিবারে ১৩৩২ সালের ২৭ মে (৭৩২ হিজরির ১ রমজান) জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠা সেখানেই। প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন বাবার কাছ। প্রভাবশালী বংশের সন্তান হওয়ায় মাগরেবের প্রথিতযথা শিক্ষকদের সান্নিধ্য পান। তিনি গণিত, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের পাশাপাশি পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ফিকাহ নিয়ে পড়েন। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তার পড়ালেখা চলে। এ সময় মিসর থেকে মৌরিতানিয়া পর্যন্ত সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় প্লেগের মহামারী (ব্ল্যাক ডেথ) দেখা দেয়। এতে তার বাবা-মা মারা যান। ১৩৫২ সালে ইবনে তাফ্রাকিনের দরবারে কিতাব আল উলামার কাজে ডাক পান। ১৩৫৫ সাল নাগাদ তিনি হয়ে ওঠেন ফেজের উলামা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে ফেজ, আন্দালুসিয়া, গ্রানাডা ও কায়রোসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সব অঞ্চলে তিনি অনেক রাজার উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেন। যা একই সঙ্গে রাজনীতিতে তার উত্থান-পতনের ইতিহাস। বলা যায়, স্পেনকে বাদ দিলে পুরো উত্তর আফ্রিকা চষে বেড়িয়েছেন। তিনি এ সব রাজ্যের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নানান ধরনের ট্রাজেডিতে পূর্ণ ছিল তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন। নিঃসঙ্গ এই ব্যক্তি শেষ জীবনে ঠাঁই পান কায়রোতে। ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশা তাকে জ্ঞানচর্চা থেকে থামাতে পারেনি।

ইবনে খালদুনের সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চল ক্ষমতার দিক থেকে পতনের দিকে যাচ্ছিল। তিনি সে সব রাজ-রাজাদের ইতিহাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তার লেখা বিখ্যাত বই ‘আল মুকাদ্দিমা’ তাকে দিয়েছে কালজয়ী দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীর সম্মান। ১৩৭৭ সালে পাঁচ মাস সময়ে বইটি রচনা করেন। এর মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানে নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। ইতিহাসের ভেতর দর্শনকে খুঁজে বের করেন। আবার ইতিহাস ও সমাজের বিশ্লেষণ করেছেন যুগপৎভাবে। ফলে ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক সূচিত হয়। যা পরবর্তীতে নৃতত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তিনি সমাজকে যাযাবর অবস্থা থেকে নগর ও রাষ্ট্রের পত্তনের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের অবস্থা পর্যন্ত ভাগ করেন। শহুরে সমাজ ও যাযাবর সমাজের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বিরোধকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখেন। সাম্রাজ্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন- ভূ-খণ্ড বিজয়, সাম্রাজ্য গঠন, সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ, শক্তি হ্রাস এবং পতন। এতে মানব সমাজের দৃঢ়তা ও দুর্বলতা, নতুন ও পুরাতন যুগ, উত্থান ও পতনের দিকে নজর দেন।

বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিলে বুঝা যায় তার আলোচনা শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামোর বাহিরের দিকে ব্যপ্ত নয়। বরং এর চেয়ে আরো গভীরে ডুব দেন। তা হলো মানুষের মনস্তত্ত্ব। এ ছাড়া অনুমাননির্ভর ধারণাকে বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষণভিত্তিক অভিজ্ঞতাকে তিনি গুরুত্ব দেন। তার মতে, ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণই উপযুক্ত পদ্ধতি। ১৮ শতকের শেষ দিকে তিনি পাশ্চাত্যে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮০৬ সালে ফ্রান্সের প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ভেল্টার দ্য সাকি মুকাদ্দিমার কয়েকটি পরিচ্ছেদ অনুবাদসহ তার জীবনী ছাপেন। এর পর অস্ট্রিয়ান প্রাচ্যবিদ ভন হ্যামার পার্গস্টল তার একটি বইয়ে তাকে ‘আরবীয় মন্টেস্কু’ বলে অভিহিত করেছেন। এর পর উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ তিনি ইউরোপে ব্যাপক পরিচিত পান। অগাস্ট ক্যোঁৎ ‘সোশিওলজি’ শব্দটি পাশ্চাত্যের অভিধানে সংযোজন করেন। তা আসলে পাঁচ শতাব্দী আগে প্রাচ্যের অভিধানে স্থান পাওয়া ‘আল উমরান’ এর পরিভাষা। এ ছাড়া ম্যাকিয়াভেলি’র ‘প্রিন্স’র ধারণা পাওয়া যায় ইবনে খালদুনের বর্ণনায়।

‘আল মুকাদ্দিমা’ বাংলায় অনুদিত হয়েছে অনেক আগে। দুই খণ্ডে অনুবাদ করেছেন গোলাম সামদানি কোরাইয়ী। এ ছাড়া এর ভূমিকা অংশটি অনুবাদ করেছেন ড. মুঈন-উদ-দীন আহমদ খান। এ ছাড়া তার বিখ্যাত আত্মজীবনীর শিরোনাম তা’রিফ বি-ইবনে খালদুন ওয়া-রিলাতুহু গারবান ওয়া-সারকার।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিুউএস/এমডি/এএল/মার্চ ১৯, ২০১৪)

Posted in Uncategorized | Leave a comment

ভারত কী করে ভাগ হলো

image (1)

ভারত কী করে ভাগ হলো

তবে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাবের আগেই হিন্দু রাজনীতির চরিত্র ধরা পড়েছিল। এ ঘটনা পরস্পরার মধ্যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গে পূর্বাঞ্চল নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ সৃষ্টি হওয়ায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হয়েছিল এই কারণে যে, এর ফলে তারা অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনার সন্ধান পেয়েছিল কিন্তু হিন্দুরা পার্টিশনের বিরোধিতা করে যে তুমুল সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করে তা ছিল মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন। দূর্গার সামনে শপথ নিয়ে সন্ত্রাসবাদীরা কাজে নামত। পার্টিশনের বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল যে, এতে হিন্দু জমিদার ও মহাজনের ক্ষমতা ও প্রভাব লাঘবের আশংকা দেখা দিয়েছিল।

ভারত কী করে ভাগ হলো- এ প্রশ্ন নিয়ে ১৯৪৭ সালের পর একাধিক বই বেরিয়েছে। পুরোনো সরকারী দলিলপত্র তথা সে যুগের রাজনীতিকদের আত্মজীবনীমূলক পুস্তকাদি যতই বেরুচ্ছে ততই অনেক রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে। ভারত পার্টিশনের অব্যবহিত পর একতরফাভাবে মুসিলম লীগ, বিশেষ করে মুসলিম লীগ নেতা কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে দোষী সাব্যস্ত করে বৃটিশ দালাল-সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ দাস ইত্যাদি উপাধি তাঁর উপর বর্ষিত হতো। বলা হতো যে, মুসলিম লীগ দ্বিজাতিতত্ত্বের ধূয়া না তুললে বা যদি আপোষ করার কোন সদিচ্ছা মুসলিম নেতাদের থাকত তাহলে ভারত বিভাগ প্রয়োজন হতো না। কংগ্রেস নেতাদের কোন দায়িত্ব এর মধ্যে থাকতে পারে- এ কথাটা কেউ আলোচনা করতে রাজি ছিলেন না। পাকিস্তানের সমর্থনে দেশে-বিদেশে যখনই কোন বই বা আলোচনা বেরিয়েছে তাকে ইতিহাসের বিকৃতি আখ্যা দেয়া হয়েছে।

ভারতীয় লেখকদের যুক্তিতে স্ববিরোধিতা থাকলেও সেটাকে রাজনীতির ক্ষেত্রে কেউ আমল দেয়নি। নৈর্ব্যক্তিক আলোচনায় তাঁরা কখনও কখনও স্বীকার করেছেন ভারত উপমহাদেশের নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের কথা। বলেছেন যে, এদিক দিয়ে ইউরোপের চেয়ে বেশী বৈচিত্র্য ভারতে বিদ্যমান। কিন্তু তবু ভারত এক জাতি একথা বলতেও তাঁদের কুণ্ঠা হয়নি। এই জাতীয়তার স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়ে অনেকে বিপাকে পড়েছেন।

আচারে, ব্যবহারে, ধর্মে, সংস্কৃতিতে, ভাষায়, সামাজিক জীবনধারায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এত প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও ভারতকে কেন এক জাতি বলা হবে- এর কোন বিতর্কাতীত সংজ্ঞা কেউ উপস্থাপিত করতে পারেনি, যা আমরা পেয়েছি, সে হচ্ছে শুধু অযৌক্তিক আস্ফালন। জওহরলাল নেহেরুর মত ব্যক্তি তাঁর ডিসকভারী অব ইণ্ডিয়াতে যখন ভারতবর্ষের সত্যিকারের রূপের আবিষ্কার করতে গেলেন, যেরূপ তিনি উদ্ঘাটন করলেন তা হচ্ছে হিন্দু ভারতের রূপ, ভারতের মধ্য যুগের সমস্ত ইতিহাস তাঁর সংজ্ঞায় স্থান পেল না। কারণ, সে ইতিহাস ছিল মুসলিম যুগের ইতিহাস। স্থাপত্যে, সাহিত্যে, ললিত কলায়, জীবনধারায় মুসলমানেরা যা কিছু করেছিলেন- যার ছাপ কখনও নিশ্চিহ্ন হবার নয়। তাকে নেহেরু আমল দিলেন না।

তেমনি অরবন্দি ঘোষ ভারতীয় সংস্কৃতির উপর যে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, সেটা ছিল গীতা-নির্ভর সংস্কৃতি। তার মধ্যে ইসলামের কোন স্থান ছিল না। ডঃ তারাচাঁদের মতো পণ্ডিত কেউ কেউ ভারতীয় জীবনে ইসলামের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন সত্য, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কোন হিন্দু নেতা সে কথা কার্যত স্বীকার করেননি। অন্যদিকে বইপত্রে দেশী-বিদেশী সব পণ্ডিত মুসলিম ও হিন্দু- এই দুই প্রধান গোষ্ঠীকে দুই ভিন্ন সভ্যতার প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

১৮৮৫ সালে কংগ্রেস পতিষ্ঠিত হয়। প্রথম প্রথম জাতীয়তাবাদের উপর ততটা জোর ছিল না, যতটা ছিল সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ নির্মাণের উপর। তখনই কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমদের মত দূরদর্শী ব্যক্তিরা মুসলমানদের হুশিয়ার করে দিচ্ছিলেন। বলেছিলেন যে, যেখানে দুই গোষ্ঠীর স্বার্থ অভিন্ন নয়, সেখানে একই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তাঁরা যোগ দিতে গেলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেবে। তাঁর সে ভবিষ্যদ্বাণী যথার্থ প্রমাণিত হয়েছিল।

কারণ, কংগ্রেস যখন জাতীয়তাবাদের কথা বলতে শুরু করল, দেখা গেল সেটা হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামান্তর মাত্র।
মহাত্মা গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে কংগ্রেসে যোগ দিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অন্য নেতারা তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হলেন তখন কংগ্রেস জাতীয়তাবাদের স্বরূপ আরও বেশী করে প্রকট হয়ে উঠল। গান্ধী প্রকাশ্যভাবে রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটালেন। রামরাজ্যের আদর্শের কথা বললেন, রামরাজ্য বলতে যে আদর্শের চিত্র মুসলিম মানসে প্রতিভাত হয়, সেটা যে একান্তভাবে হিন্দু আদর্শ- সে আপত্তিতে তিনি কর্ণপাত করলেন না। মুসলমানরা কংগ্রেসের উপর আস্থা হারিয়ে ফেরতে লাগল।

তবে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাবের আগেই হিন্দু রাজনীতির চরিত্র ধরা পড়েছিল। এ ঘটনা পরস্পরার মধ্যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গে পূর্বাঞ্চল নিয়ে নতুন একটি প্রদেশ সৃষ্টি হওয়ায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার হয়েছিল এই কারণে যে, এর ফলে তারা অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনার সন্ধান পেয়েছিল কিন্তু হিন্দুরা পার্টিশনের বিরোধিতা করে যে তুমুল সন্ত্রাসবাদের সৃষ্টি করে তা ছিল মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক আন্দোলন। দূর্গার সামনে শপথ নিয়ে সন্ত্রাসবাদীরা কাজে নামত। পার্টিশনের বিরোধিতার প্রধান কারণ ছিল যে, এতে হিন্দু জমিদার ও মহাজনের ক্ষমতা ও প্রভাব লাঘবের আশংকা দেখা দিয়েছিল।

এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের সত্যিকার রহস্য ধরা পড়ে। প্রথম প্রথম তারা বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রের কথা বলেনি। হিন্দুদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে বৃটিশরা যে ভারত সৃষ্টি করে তার আওতার মধ্যে ভবিষ্যত রচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা হতে দিল না কংগ্রেস।

এ সমস্ত কথা নতুন নয়। মুসলিম লেখকরা একাধিকবার এসব কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁরা সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধিপ্রণোদিত– এই বলে তাঁদের সমস্ত যুক্তি উড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

বর্তমান ভারতে এ সম্বন্ধে যাঁরা নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছেন তাঁদের মধ্যে ইদানীং একটা স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কিছুকাল আগে অন্নদা শংকর রায়ের ভূমিকা সম্বলিত ‘জিন্না : পাকিস্তান : নতুন ভাবনা’ নামক যে বইটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে ১৯৪৭ সালের পার্টিশন সম্বন্ধে অনেক সত্য কথা আছে, যদিও লেখক এবং অন্নদা শংকর রায় উভয়েই নিজেদের তথ্যবিরোধী এক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। একদিকে তারা দেখিয়েছেন যে, নেহেরু ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান বাতিল করায় ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, এ জন্য কায়েদে আজম জিন্নাহকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এই স্ববিরোধিতার জন্য বইটির মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। কারণ, পাঠক মাত্রই প্রশ্ন করে যে, নেহেরুর সিদ্ধান্ত যদি ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তোলে তবে জিন্নাহকে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এ জন্য জবাবদিহি করতে হবে কেন?

এদিক থেকে সদ্য (১৯৯১) প্রকাশিত ‘ভারত কী করে ভাগ হলো’? বইখানা সম্পর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। লেখক বিমলানন্দ শাসমল নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হিন্দু সমাজের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, বিচ্ছিন্নতাবাদের অংকুর ঐ সমাজের মূল বিশ্বাসগুলোর মধ্যে নিহিত ছিল। তাঁর সাহস, নির্ভীকতা বিস্ময়কর। তিনি যেখানে সত্যের সন্ধান পেয়েছেন তা উপস্থিত করতে দ্বিধা করেন নি।

ভারতের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে আলোচনা শুরু করতে গিয়ে হিন্দু হয়েও বিমলানন্দ শাসমল স্বীকার করেনে যে, ব্রাহ্মণ্যবাদের জাতিভেদ প্রথার জন্য অন্য কোন সম্প্রদায়ের বিকাশ অসম্ভব। জতিভেদ আবার প্রতিষ্ঠিত কর্মবাদের উপর। সমাজের যত অনাচার যার ফলে নিম্নবর্গের হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হয়ে আসছে তাকে বলা হয়েছে পূর্ব জন্মের কর্মফল, অর্থাৎ এর জন্য উপরের কোন শ্রেণী দায়ী নয়। এভাবেই ব্রাহ্মণ শ্রেণীর আধিপত্য সমাজে পাকা করা হয়।

এর পেছনে যে স্বার্থপরতা কাজ করেছে তার প্রভাব অহিন্দু সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংস্পর্শের উপর এসে পড়েছে, অবশ্যম্বাভী রূপে। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা চেয়েছে চিরকাল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে। তারা যে সমস্ত বিশেষ অধিকার ও সুবিধা করায়ত্ত করেছে তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি হোক, এ রকম আশংকা দেখা দিলেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মিঃ শাসমল বৃটিশ ভারতের রাজনীতির পর্যালোচনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কংগ্রেস প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিল যে, হিন্দু স্বার্থ ভিন্ন আর কোন স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজন ঘটতে পারে না। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি এবং তজ্জনিত স্বার্থবোধ অন্যরূপ হতে পারে- এ ধারণা কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আলোচনা করতেই প্রস্তুত ছিলেন না।

বঙ্গবঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় হিন্দু-মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বিশেষভাবে ধরা পড়েছিল। কিন্তু হিন্দুরা তাদের জমিদার ও মহাজন শ্রেণীর স্বার্থকে জাতীয়তাবাদ বলে চালিয়ে দিয়েছিল। লেখক দ্বিধাহীন কণ্ঠে স্বীকার করেন যে, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ছিল মুসলমানবিরোধী।

হিন্দুদের মধ্যে যে উদারপন্থী কেউ ছিলেন না, তা নয়। লেখকের পিতা বীরেন্দ্র শাসমল সন্ত্রাসবাদীদের সমালোচনা করেছিলেন বলে তাকে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে তিনি বাংলার মুসলমানদের সমস্যা বুঝতেন। কিন্তু সুভাষ বসু, শরৎ বসু, বিধান রায় এরা তাঁকে সমর্থন না করে সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করেন।

উদারপন্থী আরেক ব্যক্তি ছিলেন চিরত্তরঞ্জন দাস বা সি আর দাস। তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানদের পেছনে ফেলে স্বাধীনতা আন্দোলন সফল হবে না। এই অনুভবের প্রেরণায় ১৯২৩ সালের বঙ্গের প্যাক্ট স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যখন সুভাষ বসু সেই প্যাক্ট প্রত্যাখান করলেন তখন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের শেষ সম্ভাবনাটুকু বিলীন হয়ে গেল।

বেঙ্গল প্যাক্টে মুসলমানদের বিশেষ কোন সুবিধা দেয়ার কথা ছিল না। শুধু এই স্বীকৃতি ছিল যে, চাকরিতে এবং আইন পরিষদে তারা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব লাভ করবে। শিক্ষায় অনগ্রসরতার কারণে এতদিন তারা অবহেলিত, সি আর দাস বোঝাতেন যে, মুসলমানদের এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে না পারলে তার অকুণ্ঠচিত্তে স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীক হতে পারবে না। কিন্তু তাদের শতকরা ৫৫ ভাগ চাকরি দিতে হবে, হিন্দুদের ভাগে কিছুটা ছাড় দিতে হবে।

এটা অন্য হিন্দু নেতাদের সহ্য হল না। আরও মজার কথা- প্যাক্টে একথাও ছিল যে, মুসলমানদের মনে আঘাত লাগে এ জন্য মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো চলবে না। কংগ্রেস হিন্দুরা এখন আরো বেশী করে মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে মিছিল করতে লাগরেন। পটুয়াখালীতে যে ব্যক্তি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একজন স্থানীয় নেতা সতীন সেন। বিমলানন্দ শাসমলের ভাষায় : “বরিশালের নেতা সতীন সেন পটুয়াখালীতে এক সত্যাগ্রহ আরম্ভ করলেন। যাতে প্রতিদিন সত্যাগ্রহীরা মসজিদের সামনে বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে যেতেন এবং এই বেআইনী শোভাযাত্রা বেআইনী কাজ করে গ্রেফতার বরণ করতেন। সতীন সেন বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন।” (১০৭ পৃষ্ঠা)

পটুয়াখালী সত্যাগ্রহের জের স্বরূপ বরিশাল শহরে দাঙ্গায় ২১ জন নিরস্ত্র দরিদ্র মুসলমান পুলিশের গুলীতে মারা পড়ে।

পটুয়াখালির এই ঘটনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ জন্য যে, মসজিদের সামনে বাজনা বাজাবার এই আন্দোলন কংগ্রেসের অন্দোলনের সাথে পরিচালিত হয়েছিল এবং এর বিরুদ্ধে সর্বভারতীয় হিন্দু নেতারা যেমন কোন কথা বলেননি, তেমনি বঙ্গদেশীয় কংগ্রেস নেতারাও প্রতিবাদ করেননি।

এরপর কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে মুসলমানদের মনে কোন সংশয় থাকবার কারণ ছিল না।

এ রকম বহু ঘটনার উল্লেখ বিমালনন্দ শাসমল করেছেন। যেমন ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রী সভা করতে চাইলে গান্ধী এতে সম্মতি দিলেন না। একথাও এখানে উল্লেখযোগ্য যে, যুক্ত প্রদেশে (বর্তমানে উভয় প্রদেশ) মুসলিম লীগ ঠিক অনুরূপ প্রস্তাব কংগ্রেসকে দিয়েছিল, জওহারলাল নেহেরু সেটা নাকচ করেন। তিনি বললেন, মুসলিম লীগের সদস্যরা যদি পার্টি থেকে পদত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগদান করেন তবেই এ রকম সহযোগিতা সম্ভব।

বিমলানন্দ শাসমলের মতে, কংগ্রেসের নেতৃবর্গের হঠকারিতা ও অদূরদর্শিতার দরুনই ক্রমান্বয়ে মুসলমানদের মধ্যে এই বিশ্বাসের সঞ্চার হয় যে, অবিভক্ত ভারতে সসম্মানে জীবন ধারণের কোন আশা তাদের নেই। ১৯৪০ সালের লাহোরে তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরও যে কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী আপোষ করতে প্রস্তুত ছিলেন, তার প্রমাণ ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবকালে পাওয়া গেছে। মিঃ শাসমলের আগেও অনেকে স্বীকার করেছেন যে, ক্যাবিনেট মিশন ব্যর্থ হয় গান্ধী এবং নেহেরুর অযৌক্তিক আচরণে। মওলানা আজাদ তাঁর ‘ইণ্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন যে, নেহেরু যদি মিশন প্রস্তুতি নাকচ করে না দিতেন তবে ভারতবিভাগের প্রয়োজন পড়ত না। শাসমল তার সমর্থনে আরও যুক্তি দেখিয়েছেন।

কায়েদে আজম জিন্নাহর কাছে পাকিস্তান শেষ কথা ছিল না। সুযোগ পেলে তিনি সম্মানজনক মীমাংসায় আসতে রাজী ছিলেন। আমরা কংগ্রেসের মুখে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া গঠনের প্রস্তাবও শুনিনি। তারা আগাগোড়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে মেতেছিলেন। বিমলানন্দ বারবার স্বীকার করেছেন যে, এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে হিন্দু জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্নের কোন তফাৎ ছিল না।

কংগ্রেস যে সত্য কখনই স্বীকার করেনি, কোন কোন হিন্দু নেতা সে কথা বলেছেন। ১৯২৩ সালে ভাই পরমানন্দ বলেছিলেন, ভারতকে হিন্দু ভারত এবং মুসলিম ভারতে বিভক্ত করাই গণতন্ত্রসম্মত হবে। পাকিস্তান ও ভারত অনেকটা সেই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। কিন্তু কংগ্রেস আগাগোড়া জিদ ধরে যেমনি ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারল না, তেমনি ১৯৪৭ সালের মীমাংসাও নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে পারল না। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কের যে তিক্ততা তার মূল এখানেই।

১৯৬২ সালে নয়াদিল্লীতে আমি একবার জওহরলাল নেহেরুর বক্তৃতা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। কমনওয়েলথ শিক্ষা সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বললেন যে, ভারতের কালচারের ভিত্তি হচ্ছে সংষ্কৃত ভাষা। প্রকাশ্যত যে কালচারের কথা ভেবে নেহেরুর মুখে এই উক্তি উচ্চারিত হয়, সেটা যে হিন্দু কালচার- তাতে সন্দেহ করার কোন কারণ ছিল না। সাতশ’ বছর ধরে মুসলমানরা ভারতের বুকে যে সভ্যতা ও কালচারের সৃষ্টি করেছিল নেহেরু তাকে সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় কালচারের সংজ্ঞা থেকে বাদ দিলেন। হিন্দু হিসাবে একথা বলার অধিকার তার অবশ্যই ছিল, কিন্তু তিনিই তো ধর্মনিরপেক্ষ কালচারের কথা সবচেয়ে বেশী করে বলতেন।
একদিকে নেহেরুর বক্তৃতায় আমি যেমন বিস্মিত হয়েছি, অন্যদিকে তাঁর স্পষ্টবাদিতার প্রশংসাও করেছি। ভেবেছি, তাঁর রাজনীতিতে যদি বাস্তববাদিতা প্রকাশ পেত- অভিবক্ত ভারতকে এত দুঃখ পোহাতে হত না।

যে নীতির ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারতের সৃষ্টি হল ১৯৪৭ সালে, সেই নীতি অনুসারে কাশ্মীর পাকিস্তানভুক্ত হওয়ার কথা। এখানেও নেহেরু এমন এক নীতি অবলম্বন করলেন যার ফলে প্রকাশ্যে জাতিসংঘে প্রদত্ত সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভারত ভঙ্গ করতে বাধ্য হল। কিন্তু আবার প্রশ্ন করব, বিনিময়ে ভারত পেয়েছে কি? কাশ্মীরের সমস্ত মানবাধিকার আজ লুপ্ত। অমানুষিক নির্যাতন করে কাশ্মীর অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের কথা, নেহেরুর উত্তরসুরিরাও নেহেরুর সেই অযৌক্তিক স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে আছেন। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে কাশ্মীরীরা যেমন প্রাণ হারাচ্ছে, তেমনি ইন্ডিয়ান সৈন্য বাহিনীরও ক্ষতি হচ্ছে। তবু এই নৃশংস নাটকের কোন অবসান নেই। কোনো শর্তেই ভারত কাশ্মীরে গণভোট হতে দেবে না। সে জানে, ভোটের ফল কি হবে। এটা কি গণতন্ত্রের কথা না-কি নিছক সাম্রাজ্যবাদ?

আমরা আনন্দিত যে, বিমলানন্দ শাসমলের মতো সৎ সাহসী ব্যক্তি হিন্দু জাতীয়তাবাদের মুখোশ খুলে ফেলতে এগিয়ে এসেছেন। বিভক্ত ভারতকে আবার জোড়া লাগিয়ে এক রাষ্ট্রে পরিণত করার যে চেষ্টা ভারতীয় কূটনীতির মূল চাবিকাঠি, সেটা পরিত্যক্ত হলে এখন এই উপমহাদেশের জনগণের জীবনে শান্তি ফিরে আসবে বলে আমরা মনে করি এ জন্য চাই পরম সত্যনিষ্ঠা। তারই একটি উদাহরণস্বরূপ বিমলানন্দ শাসমলের বই-এর যথার্থ মূল্য।

সূত্রঃ মেসবাহ উদ্দীন আহ্‌মাদ সম্পাদিত ‘ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন স্মারক গ্রন্থ’

Posted in Uncategorized | Leave a comment

ইমাম ইবনে তাইমিয়া কে ছিলেন

ইবনে-তাইমিয়া-কাল্পনিক-ছবি

ইমাম ইবনে তাইমিয়া কে ছিলেন?

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন হিজরী সপ্তম শতাব্দীর একজন ‘মুজাদ্দিদ’। তিনি ছিলেন,

(ক) অসাধারণ মেধা, আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি, সূক্ষ্ম বিচারশক্তি ও সুদক্ষ তাকির্কতার পারদর্শী আলেমে-দ্বীন, (খ) অসাধারণ পান্ডিত্যের অধিকারী ফকীহ, (গ) জারাহ ও তাদীলের ইমাম, (ঘ) ক্বুরান ও হাদীসের হিফজকারী ও সঠিক ব্যখ্যা প্রদানকারী, এবং (ঙ) আল্লাহর রাস্তায় মুজাহাদা।

ইলম, তাজকিয়া ও জিহাদের ময়দানে তাঁর খিদমত এতো বেশি যে, পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সমস্ত মুসলিম আলেমরা যুগে যুগে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন এবং আছেন।

নামঃ ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর আসল নাম হচ্ছে আহমাদ ইবনে আব্দুল হালিম ইবনে তাইমিয়া। তাঁর উপাধি হচ্ছে শাইখুল ইসলাম। তিনি ‘ইবনে তাইমিয়া’ নামে বেশি পরিচিত, এটা তাঁর দাদীর নাম। উল্লেখ্য, তাঁর দাদী ছিলেন একজন আলিমাহ, এবং ইবনে তাইমিয়ার অসংখ্য উস্তাদের মাঝে তাঁর দাদীও একজন ছিলেন।

জন্ম ও মৃত্যুর স্থানঃ ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর জন্ম হয়েছিলো দামেস্কের হাররান প্রদেশে, আর মৃত্যু হয়েছিলো দামেস্কে।

জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ ও বয়সঃ ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহর জন্ম হয়েছিলো ৬৬১ হিজরি বা ইংরেজি ১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। আর মৃত্যু হয়েছিলো ৬৫ বৎসর বয়সে, ৭২৮ হিজরি বা ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে।

জীবনীঃ ইসলামী ইতিহাসের অনন্য প্রতিভার অধিকারী এই আলেমের জীবনী অত্যন্ত ঘটনা বহুল এবং সংগ্রাম মুখর। তাঁর সারাটা জীবন কেটেছে মুসলমানদের মধ্য থেকে শিরক, বিদাত দূর করার জন্যে মনপূজারীদের বিরুদ্ধে লিখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে মেহনত করা। বিদাতী আলেমদের চক্রান্তে জীবনে তাঁকে অনেক সময় জেলে কাটাতে হয়েছিলো। এমনকি ইমাম আবু হানীফার মতো তাঁর মৃত্যুও হয়েছিলো জেলখানাতে। ঐতিহাসিকগণদের কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় দুই লক্ষ মুসলমান তাঁর জানাজা পড়ার জন্যে সমবেত হয়েছিলো। তাঁর জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে আপনারা শায়খ আলীমুদ্দিন (রাহিমাহুল্লাহ) রচিত “শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ” এই বইটা পড়তে পারেন।

শায়খুল ইসলাম এর জীবনী সম্পর্কে আলোকপাত না করলেও, আমি তাঁর সম্পর্কে আমাদের পূর্ববর্তী আলেমরা কে কি বলেছেন, সে সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি।

(১) ‘সহীহ বুখারীর ব্যখ্যাকারী’, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“একজন ইমাম হিসেবে শায়খ তাক্বী উদ্দিন (ইবনে তাইমিয়ার) সম্মান ও মর্যাদা আমাদের কাছে সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল, এবং ‘শায়খুল ইসলাম’ হিসেবে তাঁর উপাধি আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যে ব্যক্তি তাঁকে (ইবনে তাইমিয়াকে) ‘শায়খুল ইসলাম’ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করবে, সে শায়খের মর্যাদা সম্পর্কে জাহেল, অথবা সে ব্যক্তি পক্ষপাতদুষ্ট। এমন কাজ যে করে সে কতইনা বড় ভুল পন্থা অবলম্বন করলো!”

আল-রাদ্দ আল-ওয়াফিরঃ পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৬, আল-জাওয়াহির ওয়াল-দু’রারঃ ২/৭৩৪-৭৩৬।

(২) ‘তাফসীরে জালালাইন’ এর লেখক, ইমাম জালাল উদ্দিন সুইয়ুতী রাহিমাহুল্লাহ ইবনে তাইমিয়ার জীবনী সম্পর্কে আলোচনায় বলেছেন,

“ইবনে তাইমিয়া হচ্ছেন আমাদের উস্তাদ, ইমাম (নেতা বা আদর্শ), একজন ‘আল্লামাহ’ (মহা পন্ডিত ব্যক্তি), হাফিজ (ক্বুরান ও অসংখ্য হাদীসের মুখস্থকারী), জারহ ও তাদীলের আলেম, ফক্বীহ, মুজাহিদ, অসাধারণ মুফাসসির, একজন‘শায়খুল ইসলাম’, যাহিদ (দুনিয়া বিমুখ ও পরকালমুখী) লোকদের জন্যে আদর্শ বা নেতা। আমাদের যুগে তাঁর সমান আর কেউ নেই।”

তাবাকাত আল-হুফফাজঃ পৃষ্ঠা ৫১৬-৫১৭।

(৩) ‘তাফসীর ইবনে কাসীর’ এর লেখক, ইমাম ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহর প্রধান উস্তাদ ছিলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া। তিনি ইবনে তাইমিয়ার পক্ষ নিয়ে শায়খের বিরোধীতাকারীদের জবাব দিতেন। ইমাম ইবনে কাসীর শায়খের পক্ষে তাঁর ‘ক্বুরানের তাফসীর’ ও তাঁর বিখ্যাত ইতিহাসের কিতাব ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিয়াহা’ তে অনেক ঘটনা ও ফতোয়া উল্লেখ করেছেন।

(৪) রিজাল শাস্ত্রের বড় আলেম, ইমাম আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন,

“তিনি (ইবনে তাইমিয়া) হচ্ছেন আমাদের উস্তাদ, একজন শায়খুল ইসলাম। আমাদের যুগে (হিজরী সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে) ইলম, সাহস, বুদ্ধিমত্তা, আধ্যাত্বিক উৎকর্ষতা,দানশীলতা, উম্মতের জন্যে কল্যাণকামীতা, সৎ কাজে আদেশ করা ও অসৎ কাজে নিষেধ করার ব্যপারে তাঁর মতো আর কেউ নেই। হাদীসের রিজালশাস্ত্র, দোষ-ত্রুটি বিচার-বিশ্লেষণ ও স্তর নির্ধারণ, মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস পৌঁছতে রাবীর কম-বেশি হওয়া সম্পর্কিত জ্ঞান, কোন হাদীস সহীহ নাকি জয়ীফ সেটা নির্ণয় করার জন্যে মতন মুখস্থ সহ যাবতীয় জ্ঞানে তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ। তাঁর যুগে তাঁর সমান মর্যাদায় কিংবা তাঁর ধারে-কাছেও কেউ পৌঁছতে পারেনি। তিনি যেকোন বিষয়ে তাৎক্ষণিক দলিল প্রমাণ সহকারে আলোচনা করার জন্য পারদর্শী ছিলেন।”

তাবাকাত আল-হানবালিয়াঃ ৪/৩৯০।

(৫) ইরাকের বিখ্যাত হানাফী আলেম, আল্লামাহ মোল্লা আলী ক্বারী রাহিমাহুল্লাহ ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাকে সমর্থন করে বলেছেন, “ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা ও তাঁর ছাত্র হাফিজ ইবনুল কাইয়্যিম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআ’তের বড় আলেম ছিলেন এবং এই উম্মতের ওলী ছিলেন।”

মানাকিবুশ-শায়খুল ইসলাম, ৬২৭ পৃষ্ঠা। hafez_nesar_quran

(৬) ভারতগুরু শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

“আমি ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহর অবস্থা যথেষ্ঠ পর্যালোচনা করেছি। তিনি ছিলেন আল্লাহর কিতাব (ক্বুরআন) সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। আভিধানিক ও শরীআ’তী পদ্ধতির ব্যখ্যায় তিনি ছিলেন সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি, রাসুলু্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের হিফাজতকারী, প্রখর স্মৃতি শক্তিধারী ব্যক্তি। সাহাবা এবং তাবিঈ’নগণের আদর্শ ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে এবং তার আভিধানিক ও শরীআ’তী অর্থগুলো সম্পর্কে তার অগাধ পান্ডিত্য ছিলো এবং তার সব কথার সাথে ক্বুরান ও সুন্নাহর প্রমান আছে।”

শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেছেন,“এই শায়খের (ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার) দৃষ্টান্ত এই পৃথিবীতে বিরল। কে আছে এমন ব্যক্তি যে তার লিখনী ও বক্তৃতার সাথে পাল্লা দিতে পারবে? যারা তার সাথে শত্রুতা করেছে তাদের বিদ্যা শায়খের বিদ্যার দশ ভাগের এক ভাগেরও সমান নয়।” [মাকতুবাতঃ ২৭-২৮ পৃষ্ঠা]

(৭) ভারতবর্ষের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব আল্লামাহ শিবলী নুমান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মাঝে মুজাদ্দিদ হওয়ার যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছিলো, তা চার ইমাম (ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেয়ী এবং ইমাম আহমাদ) এর মাঝেও ছিলোনা।”

“আন-নাদওয়াহ” মাকালাতে শিবলী, ৫ম খন্ড, ৬৫-৬৬ পৃষ্ঠা।

যুগে যুগে মুসলিম নামধারী কিন্তু আসলে বিদাতপন্থী বা মনপূজারী লোকদের মাঝে কমন একটা বদ চরিত্র হচ্ছে তারা আলেমদের আক্রমণ করে, তাদের সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে এবং তাদেরকে অপমান করার চেষ্টা করে। আলহা’মদুলিল্লাহ, মাওলা এবং সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ একাই তাঁর আওলিয়াদের জন্যে যথেষ্ঠ। যুগে যুগে বিদাতপন্থীরা শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে কুৎসা রটনা করেছে এবং আজ পর্যন্ত করছে।

বিংশ শতাব্দীতে ‘জাহমী’ মতবাদের প্রচারকারী যাহেদ আল-কাউসারী (মৃত্যু ১৯৫১ খৃস্টাব্দ) ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে লিখালিখি করে নিজেকে অপমানিত করেছিলো। কাউসারীর কুকীর্তীর ব্যপারে সতর্ক করে শায়খ বিন বাজ রাহিমাহুলাহ লিখেছিলেন, “কাউসারি ঈমানদার পরহেজগার ব্যক্তি ও উলামাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন। আমরা তার ছাত্র আবু গুদ্দাকে তার উস্তাদের এই সব ব্যপার হতে তওবা করে দূরে সরে আসার জন্যে বারবার বিশেষভাবে আহবান জানাই, কিন্ত সে তা মেনে নেয়নি। বরং, সে তার উস্তাদের মানহাজের উপর অটল রয়েছে। আল্লাহ তাকে হেদায়েত করুন এবং তার অনিষ্ট হতে মুসলিমদের হেফাজত করুন।”

সর্বশেষ, ইমাম ইবনে তাইমিয়া অনেক কিতাব এবং ফতোয়া লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। বিশেষ করে আক্বীদাহর ব্যপারে তাঁর কিতাবগুলো আহলে সুন্নত ওয়াল জামআ’তের জন্যে মহামূল্যবান মনি-মুক্তার মতো। আমরা দুয়া করি, আল্লাহ তাআ’লা ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে জান্নাতুল ফেরদাউসে সেই প্রতিদান দান করুন, তিনি যার জন্য উপযুক্ত, আমিন।

সূত্র : আওয়ার ইসলাম:

Posted in Uncategorized | Leave a comment

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার চিন্তার পুনর্পাঠ

ইবনে-তাইমিয়া-কাল্পনিক-ছবি

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার চিন্তার পুনর্পাঠ

ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে বর্তমানে আগ্রহী কোনো কর্মী, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক বা অন্য যে কারো কাছেই ইবনে তাইমিয়া একটি পরিচিত নাম। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধু নাম ও কিছু অস্পষ্ট পূর্বানুমান ছাড়া তাঁর সম্পর্কে লোকজনের তেমন জানাশোনা নেই। মৃত্যুর আট শতাধিক বছর পরেও যাকে নিয়ে বিতর্ক চলছে, কে সেই ইবনে তাইমিয়া?

হাম্বলী মাজহাবের অনুসারী একটি সম্মানিত পরিবারে আহমদ তাকিউদ্দীন ইবনে তাইমিয়ার জন্ম। ৬৬১ হিজরীর (১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) ১০ রবিউল আউয়াল তারিখে বর্তমান সিরিয়া ও তুরস্কের মাঝামাঝি অবস্থিত হার্‌রানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাত বছর বয়স পর্যন্ত তিনি সেখানেই বেড়ে ওঠেন। তারপর মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে পুরো অঞ্চলে ত্রাস ও ধ্বংসলীলা ছড়িয়ে পড়লে তাঁর পরিবার রাতের আঁধারে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। সাথে করে নিয়ে যায় যে কোনো আলেম পরিবারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ – বই।

হার্‌রান ছেড়ে দামেস্কের উদ্দেশ্যে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা অল্পবয়সী ইবনে তাইমিয়ার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এর ফলে তাতার দখলদারদের প্রতি তাঁর মনে ধীরে ধীরে তীব্র ঘৃণার জন্ম হয়। পরবর্তীতে তাঁর কলম, জবান ও তরবারী দিয়ে তাতারদের বিরোধিতায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করায় তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাঁর দৃষ্টিতে বিদআত ও ভ্রান্ত আকীদার ফলেই উম্মাহর কার্যকারিতা, জিহাদ ও ইজতিহাদের চেতনা বিনষ্ট হয়েছে। এসব থেকে উম্মাহ্‌কে মুক্ত করার মাধ্যমে তাতারদের প্রতিরোধ করার জন্যে তিনি শাসক ও জনগণকে আহ্বান করেন।

দামেস্কে পৌঁছার পরপরই ইবনে তাইমিয়ার পিতা শাইখ শিহাব উদ্দীন শহরের সমঝদার জ্ঞানী মহলে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। উমাইয়া মসজিদে দলে দলে লোকজন তাঁর দার্‌সে অংশগ্রহণ করতো। তিনি দারুল হাদীস আল-শুক্কারিয়্যাহ্‌র শাইখ হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। তাঁর পুত্র এই পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন।

তাকিউদ্দীন অল্প বয়সেই কোরআন হিফজ করেন। কোরআনের পাশাপাশি তিনি তাঁর বাবার কাছে হাদীস ও ফিকাহ্‌র পাঠ নেন। এছাড়া অন্যান্য আলেমের অধীনে ভাষাবিজ্ঞান, উসূল এবং দ্বীনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অধ্যয়ন করেন। তরুণ ইবনে তাইমিয়া শুধু পরিবার থেকে প্রাপ্ত বিষয়সমূহের শিক্ষায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তিনি গভীরভাবে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, গণিত, বীজগণিত, এবং ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি দ্রুত মুখস্ত করতে পারতেন এবং খুব কমই ভুলতেন।

বিশ বছর বয়সের পূর্বেই তিনি ফতোয়া দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে উঠেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি দারুল হাদীস আল-শুক্কারিয়ায় হাদীস ও ফিক্‌হের শিক্ষক হিসেবে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল একুশ বছর। উমাইয়া মসজিদেও তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। সেখানে তিনি তাফসীরের ওপর দার্‌স দিতেন। ১২৯৬ সালে তাঁর শিক্ষক ও মাদ্রাসা আল-হাম্বলিয়ার ফিকাহ শাস্ত্রের অধ্যাপক যাইনুদ্দীন ইবনে মুনাজ্জা মৃত্যুবরণ করেন। ইবনে তাইমিয়া পরবর্তীতে সে পদে যোগদান করেন।
ইবনে তাইমিয়া উপলব্ধি করেন তাওহীদ হচ্ছে ইসলামের মূল কেন্দ্রবিন্দু।

ফলে হেলেনীয় দর্শন, অজ্ঞেয়বাদ, অবান্তর ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্ক এবং দার্শনিক মরমিবাদ থেকে ইসলামী চিন্তা ও আকীদাকে মুক্ত করতে তিনি জীবনের বিরাট অংশ ব্যয় করেন। ইসলামী সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রেই এই বিষয়গুলো গভীরভাবে গেড়ে বসেছিল। বিশেষ করে মানুষের ধারণা, বিশ্বজগতে তার অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত ধারণাগুলো ‘ওয়াহ্‌দাতুল ওজুদ’ (সর্বেশ্বরবাদী অদ্বৈতবাদ – এতে মনে করা হয় – সবকিছু একই সত্ত্বার নির্যাস) ও ‘হুলুল’ (অবতারবাদ) সংক্রান্ত আকীদা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ইবনে তাইমিয়া এ সমস্ত আকীদার ব্যাপারে শংকিত হয়ে উঠেছিলেন। এগুলো বিভাজন, সংশয়, কঠোরতা এবং নিষ্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। এগুলো উম্মাহ্‌র ভিত্তিমূলে আঘাত করার মাধ্যমে এর গতিশীলতাকে স্তব্ধ করে দিচ্ছিলো এবং উম্মাহ যে সমস্ত বিপদের সম্মুখীন সেগুলোর ব্যাপারেও অনুভূতিশূন্য করে তুলছিলো।

ইবনে তাইমিয়া ছিলেন সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক। পতনোন্মুখ ঐতিহ্য, ফিক্‌হী তাকলীদ, সমাজবিচ্ছিন্ন বিভিন্ন তরিকা ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার মধ্যে পারস্পরিক শক্তিশালী মৈত্রিতার কারণে জীবদ্দশায় তাঁর সংস্কারচিন্তা সাফল্য ও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও তা বৃথা যায়নি। সমকালীন সংস্কার আন্দোলনে তাঁর কর্মপ্রচেষ্টার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ইবনে তাইমিয়ার তৎপরতা ও পুনর্জাগরণ প্রচেষ্টার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে – একদিকে উম্মাহর বাস্তবতা ও সংকটের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন এবং অন্যদিকে প্রকৃত উৎসের সাথে এ বাস্তবতার সংযোগ পুনঃস্থাপন, পরবর্তীকালে যুক্ত হওয়া বিচ্যুতিগুলো থেকে তাওহীদী আকীদাকে মুক্ত করা, আল্লাহ প্রদত্ত শিক্ষা ও মিশনের প্রতি মানুষের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি এবং ইজতেহাদ ও জিহাদের গুরুত্ব তুলে ধরা।

বর্তমানে কোরআন-হাদীসের আলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাত্যহিক জীবনের সমস্যাগুলোর ব্যাখ্যা দেখতে দেখতে অনেকে হয়ত এই সমস্ত ইজতিহাদী মূলনীতিকে স্বাভাবিক ধরে নেয়। এ কারণে তারা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া কিংবা পরবর্তীকালের যেসব সংস্কারবাদীরা এই কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন এবং ইতিহাসের ধ্বংসস্তুপ থেকে বের করে এনেছেন তাঁদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারে না।

এসব পথপ্রদর্শনমূলক প্রচেষ্টাগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে যেসব তরুণ সচেতন নয়, তাদের জন্যে এটুকু বলাই হয়তো যথেষ্ট হবে – ইজতিহাদ করার অভিযোগে একদল আলেমকে আঠারো শতকের শেষ দিকে দামেস্কে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল! যাইহোক, এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সমকালীন সংস্কার আন্দোলনগুলো ইবনে তাইমিয়ার চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা বাহ্যিক সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে।

অথচ ইবনে তাইমিয়া বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং সামাজিক সুবিচারের মতো অসাধারণ মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর চিন্তার এই সামাজিক দিকগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংস্কার আন্দোলনগুলোতে অবহেলিত ও প্রান্তিক রয়ে গেছে। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, এই মহান আলেমের অনুসারী বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তারা সবাই তাঁর চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করেন এমনটা মনে করার কারণ নেই।

তিনি নুসুসের সহায়তা ছাড়াই রাজনৈতিক তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বিচারের মূলনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যুম আল-জাওযিয়্যাহ্‌ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, রাজনৈতিক তত্ত্ব কোরআন-হাদীস দ্বারা নির্দেশিত হওয়া জরুরি নয়। এটি কোরআন-হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়াটাই যথেষ্ট। ইবনে তাইমিয়া উম্মাহ্‌র অনুমোদনের নীতিকে শাসকের বৈধতার একমাত্র ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। উদাহরণস্বরুপ তিনি ব্যাখ্যা করেন, রাসূলের (সা) ওফাতের পর সংঘটিত আল-সাকীফার চুক্তি কিংবা উমর (রা) কর্তৃক গঠিত ছয় সাহাবীর শুরা কর্তৃক উসমান (রা) এর নিয়োগে অঙ্গীকার বাধ্যতামূলক (বাইয়্যাত) ছিল না বরঞ্চ তা ছিল মনোনয়ন মাত্র। মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও একচেটিয়া বাজার রোধকল্পে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের নীতি এবং রাষ্ট্রের সামাজিক ভূমিকা সক্রিয় করার লক্ষ্যে অন্যান্য প্রক্রিয়াও ইবনে তাইমিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।

একজন চিন্তাবিদ যে সময়ে বাস করেছেন, যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন এবং যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও বিষয়াদির সম্মুখীন হয়েছেন সেই আলোকে তার লেখা পাঠ করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে এটিই ইসলামের বাণীর বৈশিষ্ট্য। ইসলামের এই চিরন্তন বৈশিষ্ট্যই নতুন পরিস্থিতির আলোকে কোরআন-হাদীসের পুনর্ব্যাখ্যাকারী সংস্কারকদের আবির্ভাবকে অপরিহার্য করে তোলে।

সপ্তম ও অষ্টম শতকের সাংস্কৃতিক জীবন ছিল অনেকটা নিম্নরূপ:
সুন্নী মুসলমানদের মধ্যে ফিকাহ সংক্রান্ত বিষয়ে চার মাজহাবের প্রবল তাকলীদ বিদ্যমান ছিল। পূর্ববর্তীদের কাজের ব্যাখ্যা ও সারসংক্ষেপ তৈরি করার মধ্যেই মূলত তৎকালীন ফকীহদের তৎপরতা সীমিত ছিল। এছাড়া ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ মাজহাব থেকে স্বীয় মাজহাবকে রক্ষা করায়ও তারা ব্যস্ত থাকতেন।

যখন কোনো শাসক নির্দিষ্ট একটি মাজহাব গ্রহণ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো মাজহাবের আলেমদের প্রশ্রয় দিতেন, তখন মাজহাবগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো বেড়ে যেত। ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী ঐতিহ্যে বেড়ে উঠেছিলেন এবং ইমাম আহমদের প্রতি তাঁর অশেষ শ্রদ্ধা ছিল। তথাপি তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন চিন্তাবিদ, যিনি কেবল কোরআন ও হাদীসের বিশুদ্ধ বর্ণনা এবং সাহাবী ও তাঁদের উত্তরসূরীদের উদাহরণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতেন। এর ফলে তিনি এমন ইজতিহাদ ও মতামত দিয়েছেন যা শুধু তাঁর নিজের মাজহাব থেকেই ভিন্ন ছিলো না বরং চার মাজহাব থেকেই ভিন্ন ছিলো।

তিনি তাকলীদের সীমানা ভাঙ্গার মাধ্যমে অসাধারণ সাহসের পরিচয় দেন। এই সাহসের কারণে তাঁকে অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাঁকে তাকলীদপন্থী আলেম ও তাঁদের অনুসারীদের আক্রোশের শিকার হতে হয়।
তারবিয়্যাহ্‌র ক্ষেত্রে তাসাউফের প্রভাব ছিল প্রবল। কিন্তু ততদিনে তাসাউফের অংশবিশেষ ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ (অদ্বৈতবাদ), ‘হুলুল’ (অবতারবাদ) এবং ‘জাবরিয়া’ (অদৃষ্টবাদ) আকীদাগুলো দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইবনে তাইমিয়া এইসব আকীদা, হালাল-হারামের প্রতি অবহেলা এবং স্বৈরাচারী শাসক ও দখলদারদের জোটবদ্ধতার বিরোধিতা করেন। বৈরাগ্যবাদসহ যে সমস্ত বিদআত তাসাউফের ভেতর অনুপ্রবেশ করেছিল তিনি সেগুলোর বিরোধিতা করেন।

তাঁর মতে, দারিদ্র্য ও দুর্বলতাকে মহিমান্বিত করা ইসলামবিরুদ্ধ এইসব আকীদা খ্রিষ্টধর্ম (যে ধর্ম নিজেই গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত) থেকে আমদানি করা হয়েছে। বিভিন্ন মাজহাব ও তাসাউফের মধ্যে বিভাজন সমাজকে আরো বেশি বিভক্ত করে। বিশেষ করে, কারো কারো প্রতি রাষ্ট্রের সমর্থনের ফলে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে আসীন যাজকতন্ত্রের মতোই একটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। এই বিচ্যুতিগুলো ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকগুলোকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে ইসলামকে একটি আচারসর্বস্ব অদৃষ্টবাদী বৈরাগ্যবাদে পরিণত করে।

তাসাউফের প্রতি তাঁর তীব্র সমালোচনার ফলে এর প্রতি তাঁর বিরোধিতা সম্পর্কে সৃষ্ট ধারণা সত্ত্বেও বলা চলে তিনি তাসাউফের ব্যাপারে তাঁর মতামতগুলো সরলীকরণ করেননি। বরং তিনি তাসাউফের বিশুদ্ধ ও বিচ্যুত ধারার মধ্যে পার্থক্য করেছেন মাত্র। তিনি প্রায়ই আল জোনাইদ ও আল কায়লানীর মতো তাসাউফের প্রথম দিককার শায়েখদের প্রশংসা করতেন। আর আল হাল্লাজ, ইবনে ‘আরাবী, ইবনে সাবঈন, আন নাকাবী ও অন্যান্যদের দার্শনিক মরমিবাদের সমালোচনা করতেন।

তিনি সুন্নাহ্‌র সাথে সাংঘর্ষিক আচারসমূহের সমালোচনা করতেন। তাতার, ক্রুসেডার ও স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার বিরোধিতা করেছেন। হাম্বলী সুফী আব্দুল কাদির জিলানীর নামানুসারে গড়ে ওঠা কাদেরিয়া সুফী তরীকার সাথে ইবনে তাইমিয়া সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি তাঁর প্রশংসা করতেন। এমনকি আব্দুল কাদির জিলানীর রচিত “ফুতুহ্‌ আল-গায়েব” বইয়ের অংশবিশেষের ব্যাখ্যা হিসেবে ইবনে তাইমিয়া “শরহে ফুতুহ্‌ আল-গায়েব” নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেন।

এভাবে তৎকালীন পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জসমূহ ইবনে তাইমিয়ার কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি তাঁর কাজকে প্রভাবিতও করেছে। তাঁর লেখালেখিগুলো তাঁর গভীর জ্ঞান ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে। তিনি তাঁর লেখালেখিতে তৎকালীন সংস্কৃতিকে বুঝা ও একে শরয়ী মানদণ্ডে বিচার করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ওহী (মানকুল) ও যুক্তিবোধ (মা’কুল) উভয়কেই তিনি শরয়ী মানদণ্ডের অংশ মনে করতেন। আল্লাহ, রাসূল (সা) ও সালফে সালেহীনদের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তীক্ষ্ণ মননের সমন্বয়ে তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেন।

ইবনে তাইমিয়া মনে করতেন, উম্মাহ্‌ তার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। তিনিসহ অন্যান্য সংস্কারকগণ উম্মাহ্‌র পতন, পশ্চাৎপদতা ও অন্য জাতির অধীনস্ত হওয়ার প্রকৃত কারণ হিসেবে উম্মাহ্‌ ও ইসলামের মধ্যে তৈরি হওয়া দূরত্বকে চিহ্নিত করেন। ইমাম মালিকের বক্তব্যের মূলনীতির আলোকে তিনি একটি সামগ্রিক সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু করেন। ইমাম মালিক বলেছিলেন: “এই উম্মাহ্‌র পরবর্তী প্রজন্মগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত সফল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ঐ পদ্ধতি অবলম্বন করবে, যা প্রথম প্রজন্মকে সফল করেছিল।”

ইবনে তাইমিয়া সালাফদের অনুসৃত পদ্ধতির আলোকে ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের পদ্ধতির বিরোধিতা করেন। এ পদ্ধতি শরীয়াহ্‌কে মনন দ্বারা বিচারের স্থলে শরীয়াহ্‌ দ্বারাই বিচারের নীতি ধারণ করতো, এই অনুমানের ভিত্তিতে যে এই দুয়ের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো ধরণের সংঘাত নেই। তিনি আলেমদের কঠোরতা অবলম্বনের নীতিরও বিরোধিতা করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ইজতিহাদের ডাক দেন এবং মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো কোরআন-সুন্নাহ্‌র আলোকে বিবেচনা করার আহবান জানান।

সালাফদের আকীদার দিকে আহবানের মাধ্যমে তিনি ‘হুলুল’ ও ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ আকীদার বিরোধিতা করেন। তাকওয়া ও জিহাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নবুয়তী তারবিয়্যাহ্‌র দিকে আহবানের মাধ্যমে ভ্রান্ত আকীদাগুলোর তারবিয়্যাহ্‌ ও সুলুকের বিরোধিতা করেন। তিনি শাসকদের স্বৈরাচারিতা এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্বের প্রতি অবহেলার বিরোধিতা করেন। তিনি এমন একটি সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাব করেন যা শাসক ও শাসিতের পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। এই ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দরিদ্রদের সুরক্ষা প্রদান, বণ্টন ও মূল্য নির্ধারণে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাসহ জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে। ‘আল-হিসবা’ বইয়ে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।

উপরোক্ত বক্তব্য সত্ত্বেও ইবনে তাইমিয়া বিভক্তির দিকে ডাকেননি। তিনি শাসক, আলেম ও জনগণসহ সমস্ত উম্মাহ্‌কে পুনর্জাগরিত ও পুনুরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি কেবল বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বাস্তবেও অনেক কিছু করেছেন। তিনি প্রায়ই জনগণের অভিযোগ ও দাবি নিয়ে সরাসরি শাসকদের কাছে চলে যেতেন। তিনি দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন। এমনকি যুদ্ধবন্দীদের সংকট নিরসনে রাজনৈতিকভাবে ভূমিকা রেখেছেন।

তাঁর মতো মহান সংস্কারককে বুঝতে হলে তৎকালীন বাহ্যিক সামরিক ও সভ্যতার চ্যালেঞ্জসমূহ এবং অভ্যন্তরীণ সংকটগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। এই বহুবিধ সংকট উম্মাহ্‌কে একটি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছিল। এর ফলে পারস্পরিক সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানের পরিবর্তে উম্মাহ্‌ নিজস্ব স্বতন্ত্র চরিত্রের সন্ধানে অধিক জোর দিয়েছিল। এই জায়গা থেকে দেখলে এটি স্পষ্ট হয়, ইবনে তাইমিয়ার কর্মপ্রচেষ্টা ছিল তাঁর সময়ের চ্যালেঞ্জ ও অগ্রাধিকারের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া।

যাইহোক, তিনি এমন একটি সময়ে কাজ শুরু করেছিলেন যখন উম্মাহ গভীর পতনের সম্মুখীন। ফলে তাঁর আহবান তাদের সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটায়। তাঁর আহবানকে বিবেচনায় নেয়ার পরিবর্তে উম্মাহ্‌র নেতৃবৃন্দ একে স্তব্ধ করে দিতে উঠেপড়ে লাগে। তিনি একের পর এক বিচারের সম্মুখীন হন। প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি ইবনে তাইমিয়াকে নয়, বরং যে রেনেসাঁর আহ্বান তিনি জানাচ্ছিলেন তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। এবং এর বিচারক কোনো মালিকী অথবা শাফিয়ী আলেম ছিলেন না বরং এর বিচারক ছিল তৎকালীন যুগের পতনাবস্থা। শাফেয়ী মাজহাবভুক্ত তাঁর শিষ্য আল-বিরজালী, আয-যাহাবী, ইবনে কাসীর এবং হাম্বলী মাজহাবভুক্ত জীবনীকার ইবনে রজব ইবনে তাইমিয়ার জীবনের এই কঠিন পরীক্ষাগুলো নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। তবে তাঁর নিজের মতে, বন্দীজীবন ছিল তাঁর জন্যে রহমতস্বরূপ, যা ইলমের সাথে আমলের সম্মান এবং ইজতিহাদের সাথে জিহাদের মুকুটে তাঁকে সজ্জিত করেছে।

জীবনীকারগণ ইবনে তাইমিয়ার বন্দীজীবনের বেশ কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, যা তাঁর ঐ সময়ের মানসিক অবস্থার পরিচয় দেয়। যেমন: “আমার শত্রুরা আমার কিই-বা করতে পারে? আমার জান্নাত তো আমার অন্তরে, আমি যেখানেই যাই তা আমার সাথেই থাকে; একে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কারাগার হলো আমার জন্য নির্জন আশ্রয়; মৃত্যুদণ্ড হলো শাহাদাতের সুযোগ এবং নির্বাসন হলো ভ্রমণের সুযোগ।”

ইবনে তাইমিয়ার মৃত্যুর তিন মাস আগে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আল-ইখনা’য়ী সুলতানের কাছে নালিশ করেন। এই ব্যক্তির যুক্তি খণ্ডন করে একবার ইবনে তাইমিয়া একটি লেখা লিখেছিলেন। আল-ইখনা’য়ীর নালিশের প্রেক্ষিতে ইবনে তাইমিয়াকে কারাগারে লেখালেখি করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার আদেশ দেয়া হয়। ফলে তাঁর কাগজ, কালি ও কলম ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৭২৮ হিজরীর ২০ জিলকদ (২৬ সেপ্টেম্বর, ১৩২৮) ইবনে তাইমিয়া ৬৫ বছর বয়সে জেলখানায় মৃত্যুবরণ করেন। ইবনে কাসীরের মতে, ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ লোক তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিল। এর মাঝে ১৫ হাজার ছিলেন নারী।
আল হাফিজ আল মিজ্জী বলেছেন, “আমি তাঁর মতো আর কাউকে দেখিনি, তিনিও তাঁর মতো কাউকে দেখেননি। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (সা) সুন্নাহর ব্যাপারে তাঁর মতো জ্ঞানী ও পাবন্দী আর কাউকে আমি দেখিনি।”
সূত্রঃ Ibn Taymiyyah: Misunderstood Genius
http://shoncharon.com/2016/01/13/শাইখুল-ইসলাম-ইবনে-তাইমিয়/

Posted in Uncategorized | Leave a comment

মুজিব হত্যার নীলনক্সা : আমি যতটুকু জানি_ আহমদ ছফা

baba

মুজিব হত্যার নীলনক্সা : আমি যতটুকু জানি_

আহমদ ছফা

নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ – আহমদ ছফা (৩৬৭-৩৭৮ পৃষ্ঠা)

উনিশ শ পঁচাত্তর সালের চৌদ্দই আগস্টের রাতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। শেখ মুজিব-হত্যাকাণ্ডের অনুপুঙ্খ বিবরণ এখনো লিখিত হয়নি। দেশি-বিদেশি অনেক লেখক-সাংবাদিক এই বিষয়টি নিয়ে একাধিক পুস্তক রচনা করেছেন। তারপরেও একথা নিশ্চিত সত্য যে, আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে আমাদের জনগণের কৌতুহল চরিতাৰ্থ করার উপযোগী করে হত্যাকাণ্ড নাটকের একটি বিশ্বাসযোগ্য গ্ৰন্থ অদ্যাবধি রচিত হয়নি। আমার বিশ্বাস ভবিষ্যতে গবেষকদের দৃষ্টি শেখ মুজিব-হত্যাকাণ্ডের মত অপরিসীম গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হবে। অনেকগুলো কারণেই এ বিষয়টি গুরুত্বসম্পন্ন।

প্রথমত, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে জনযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্মানো বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তি কীভাবে ঘটল, গবেষকরা তীক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করলে মুক্তিযুদ্ধের আপাত বিজয় শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় কি করে পর্যবসিত হল, সে কাহিনী বেরিয়ে আসবে।

দ্বিতীয়ত, একটি দেশের ভেতরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অন্দরমহলে বিশ্বাসঘাতকতার শক্তি কীভাবে ঘাপটি মেরে আত্মপ্রকাশের উপযুক্ত সময়টির প্রতীক্ষা করতে থাকে তারও একটি চিত্র পাওয়া যাবে।

তৃতীয়ত, মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে জন্ম নেয়া একটি দেশের অহংপুষ্ট শাসকগোষ্ঠী বুলিসর্বস্ব জাতীয়তাবাদের স্লোগান আউড়ে জনগণের মধ্যে মোহের মায়াজাল সৃষ্টি করে না শুধু, শাসকগোষ্ঠী নিজেরাও নিজেদের উচ্চারিত মিথ্যা বুলির শিকারে পরিণত হয়; জনগণকে রক্ষা করা দূরে থাকুক শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষা করার ক্ষমতাও তাঁদের থাকে না, গবেষকরা মুজিব হত্যা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তার একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পেয়ে যাবেন।

চতুর্থত, তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কোন ত্রুটি, কোন গলদ এবং কোন ফাঁক ফোকড়ের ভেতর দিয়ে সামরিক বাহিনী শাসনকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তার সঙ্গত যুক্তিগ্রাহ্য কারণগুলো উদ্ভাবন করতে পারবেন।

সাম্প্রতিক সময়ে গবেষকরা নানা উৎস ঘেঁটে যে সকল প্ৰমাণপঞ্জি সংগ্ৰহ করেছেন, তার ভিত্তিতেই অবলীলায় বলে দেয়া যায়, মুজিব হত্যা ক্ষণিকের স্বতঃস্ফূর্ততায় মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া নিছক একটা বিয়োগান্ত নাটক নয়; বরং বলা যেতে পারে এটা এমন একটা ঘটনা যা অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং কুশলী পরিকল্পনাবিদেরা একটা দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরম্পরা প্রণয়ন করে ঘটিয়ে তুলেছিল।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস পরবর্তী পৃষ্ঠাসমূহে আমি যেসব কথা বলব, যে সকল ঘটনার বর্ণনা করব এবং যে সকল ব্যক্তির নাম উল্লেখ করব, সে সকল ব্যক্তি এবং ঘটনার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে। যেহেতু নিজের মুখে আমি বিষয়টি বিবৃত করছি, তাই আমার নিজের প্রসঙ্গেও কিছু কিছু কথাবার্তা বলতে হবে। নিজেকে উহ্য রেখে কাহিনীটা প্রকাশ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। কিন্তু সেটা অসম্ভব। বর্ণিতব্য বিষয় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে। নিজের জ্ঞান এবং বিশ্বাস অনুসারে একটুকুও অতিরঞ্জিত না করে যা শুনেছি। এবং দেখেছি, বর্তমান রচনাটিতে সেসব কথা বলে যাচ্ছি।

প্ৰথমে নিজের কথা বলি। উনিশ শ একাত্তর সালের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার বহু পূর্ব থেকে, একজন লেখক কর্মী হিসেবে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উলঙ্গ আক্রমণের পর অন্যান্যদের মত আমিও ভারতে যাই। আমি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না। তাছাড়া আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের অনুগামী দুটি দলের লোকজন আমাকে বামপন্থী হঠকারী মনে করত এবং আমার প্রতি সন্দেহ পোষণ করত। সেজন্য ইচ্ছা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। লেখালেখির মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের কাজ করেছি।

কোলকাতা থেকে স্বাধীন দেশে ফেরার পর শাসকদল আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ দেখে আমার অন্তর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। লিখিতভাবে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ করতে থাকি। সে সময়ে আমি ছিলাম বাংলা একাডেমীর গবেষক। ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকাটি সবে প্ৰকাশিত হতে শুরু করেছে। ওই কাগজে নিয়মিত কলাম লেখার কারণে সরকারি দৃষ্টিতে বিস্তর সুখ্যাতি অর্জন করি। এক সময়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে আমাকে একাডেমীর কাজটি ছেড়ে দিতে হয়। সেই সময়ে বর্তমান জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান। আমি তাঁর বিশেষ স্নেহভাজন ছিলাম। তিনি আমাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধীনে গবেষণাটি চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন। তখন “জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল” গঠিত হয়েছে। তাদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠে’র লেখক হিসেবে ঐ দলটির খুচরোখাচরা নানাবিধ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। জাসদের মুখপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিখেছি, জাসদের, ছাত্রলীগের, শ্রমিক-লীগের প্লাটফর্ম থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছি। তখনকার আওয়ামী লীগের ভদ্র শান্ত চেহারা ছিল না। কেউ টু-শব্দটি উচ্চারণ করলেও টুঁটি চেপে ধরতে ছুটে আসত। তথাপি আমরা সাহস করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, লিখেছি, এবং সভা সমিতির আয়োজন করেছি। সেসব কথা থাকুক। আবার নিজের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চূড়ান্ত খারাপ অবস্থার মধ্যে আমার দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছিল। পঁচাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে আমি গবেষণা কর্মটি চিঠি লিখে ছেড়ে দেই। এক ধরনের অভিমান থেকে আমি তা করি।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা মিসেস হুসনে আরা হক আমাকে স্নেহ করতেন। এক সময়ে আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম। তাঁর স্বামী জনাব আজিজুল হক ছিলেন পাকিস্তান আমলে ‘কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’র ডিরেক্টর। পরে জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি কৃষিমন্ত্রী হয়েছিলেন। তারও পরে তিনি আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সিরডাপের’ প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। সেই সময়ে সেই পরিস্থিতিতে দুবেলা অন্ন সংস্থান করাও আমার পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আমার দুর্দশা দেখে জনাব আজিজুল হক দয়া পরবশ হয়ে ‘ইউনিসেফ’ থেকে আমার জন্য একটি গবেষণা প্ৰকল্প সংগ্রহ করেন। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, ঐ সময়ে জনাব হক ছিলেন ইউনিসেফের বাংলাদেশ শাখার প্রধান উপদেষ্টা । গ্যাসকার্ট নামে ইউনিসেফের একজন জার্মান তরুণের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। গ্যাসকার্ট ছিলেন জার্মান সাহিত্যের অনুরাগী এবং ভাল বেহালাও বাজাতেন। গ্যাসকার্ট একজন আইরিশ মহিলার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। খুব সম্ভবত আমার মত অনভিজ্ঞ একজন লোকের একটি গবেষণা প্রকল্পের ব্যবস্থা করে দেয়ার ব্যাপারে তিনিও কিছু ভূমিকা পালন করে থাকবেন। আমি একটি গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করব এটা তো নিশ্চিত হল। কিন্তু গোল বাধল একটা ব্যাপারে। উন্নয়নের ব্যাপারে আমার সামান্যতম অভিজ্ঞতাও নেই। তাই আজিজুল হক সাহেব আমার হাতে সাত হাজার টাকার একটি চেক দিলেন এবং বললেন এক মাসের জন্য কুমিল্লা একাডেমীতে যাও। সেখানে যে লাইব্রেরিটি আছে তাতে সমাজ উন্নয়ন বিষয়ক অনেক বইপুস্তক আছে। মাসখানেক পড়াশোনা করে প্রাথমিক ধারণাটি গঠন কর।

১৯৭৫ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে সমাজ উন্নয়নের বিষয়ে পড়াশোনার জন্য আমি ‘কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমী’তে আসি। ওই একাডেমীতে থাকার সময়ে আমার চোখের সামনে যে সমস্ত ঘটনা ঘটতে দেখেছি, পরবর্তীকালে কার্যকারণ মিলিয়ে যখন বিচার করেছি, আমার মনে এই ধারণাটি দৃঢ়মূল হয়েছে যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করার যে ষড়যন্ত্র হচ্ছিল তাতে কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমী একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের উল্লেখ না করলে আমার কাহিনীটি বলা সম্ভব হবে না। তাই বাধ্য হয়ে আমার নিজের সম্পর্কে কিছু কথাবার্তা বলতে হচ্ছে। সপ্তাহতিনেক সমাজ উন্নয়নবিষয়ক বইপত্র নাড়াচাড়া করে দেখলাম। শেষ পর্যন্ত নিজের সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, আমাকে দিয়ে গবেষণা-টবেষণা ওসব কাজ হবে না। আমার মনের ধাঁচটা ভিন্ন রকমের। অন্যের লেখা গবেষণামূলক পুস্তক পড়তে মন্দ লাগে না। কিন্তু নিজে গবেষণা করে কিছু লেখার প্রশ্ন উঠলেই একটা অনীহাবোধ আমাকে পেয়ে বসে। গবেষণা তো করব না ঠিক করেছি, কিন্তু কী করব। কিছু একটা করতে তো হবে। বলে রাখা ভাল আজিজুল হক যে সাত হাজার টাকা আমাকে দিয়েছিলেন, তার প্রায় অর্ধেক ঢাকায় বসেই আমি খরচ করে ফেলেছি। বাকি সাড়ে তিন হাজারও একরকম খরচ হওয়ার পথে। হোস্টেলের ভাড়া দিতে হয়, দুবেলা খাওয়া, সিগারেট, চা এবং প্রতিদিন কুমিল্লা শহরে সুধা সেনের বাড়িতে কীর্তন শুনতে যাওয়া। তাড়াতাড়িই টাকাটা ফুরিয়ে আসছিল। হক সাহেবের কাছে কি কৈফিয়ত দেব, তার চাইতে আমার চিন্তা ছিল, সামনের দিনগুলোতে আমি কি করে ভাত খাব। ইউনিসেফের প্রকল্পের কাজ করব না, ঠিক করেছি। কিন্তু কী করব।

তারিখটা বলতে পারব না। দিন তারিখ মাস এসব ব্যাপারে আমার খুব তালগোল পাকিয়ে যায়। আর সবসময় ডায়েরি রাখার অভ্যাসও আমার নেই। এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে এক শুক্রবার একজন লুঙ্গিপরা ফর্সাপানা চেহারার এক ভদ্রলোক লাইব্রেরির কাছে সিঁড়ির গোড়ায় আমাকে ডেকে চাটিগেঁয়ে ভাষায় বেশ নরম জবানে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আহমদ ছফা নন? একটুখানি অবাক হয়ে গেলাম, কারণ ভদ্রলোককে এর আগে কখনো দেখিনি। লুঙ্গি, হাফহাতা হাওয়াই সার্ট এবং মাথার ওপর কিস্তি টুপি, কাপড়ে-চোপড়ে একেবারে সাধারণ। কিন্তু মুখের বচন তাঁর অঙ্গের ভূষণের বিরোধিতা করছে। আমি স্বীকার করলাম, আহমদ ছফা আমার নাম বটে এবং জানতে চাইলাম তিনি কি করে আমাকে চিনলেন?

তিনি বললেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি মিলনায়তনে তিনি একটি আলোচনা সভায় আমাকে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এককালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য প্রফেসর আনিসুর রহমানের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে শুনেছেন। আমি বিস্মিত হয়ে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন, তাঁর নাম মাহবুবুল আলম চাষী এবং তিনি কুমিল্লা উন্নয়ন একাডেমীর ভাইস প্রেসিডেন্ট। এতদিন ধরে একাডেমীর হোস্টেলে থাকছি। অথচ তাঁর সঙ্গে মুলাকাত করিনি, সেজন্য মৃদু অভিযোগ করলেন। আগেও একাধিকবার আমি মাহবুবুল আলম চাষীর নাম শুনেছি। শুনেছি তিনি গ্রামের মানুষের সেবা করার জন্য ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কলকাতায় থাকার সময়েও এক আধবার তাঁর নাম শুনে থাকব । তিনি যে এই একাডেমীতে আছেন এবং সৰ্বক্ষণ লুঙ্গি পরে থাকেন আমি জানতাম না।

চাষী সাহেব আমাকে আদর করে তাঁর অফিসে ডেকে নিয়ে গেলেন, চা খাওয়ালেন, আমি সিগারেট খাই জেনে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চাষী সাহেব আমাকে এমন একটা প্রস্তাব দিলেন, আমি তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আপনাদের মত জ্ঞানীগুণী মানুষেরা বুদ্ধি-পরামর্শ না দিলে বঙ্গবন্ধু যে সামাজতন্ত্র করতে চান, তা কেমন করে সম্ভব হবে? চাষী সাহেবের কথাটি শুনে আমার তো হাসি এসে গিয়েছিল। শেখ সাহেবের লোকেরা আমাকে সমাজতন্ত্রের শক্ৰ মনে করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, আর চাষী সাহেব কিনা বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা যদি অংশগ্রহণ না করি, তা হলে তিনি সমাজতন্ত্র করবেন কাদের দিয়ে? আমার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাকে বেশি কিছু না জানিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে আমি সাহায্য করতে পারি? চাষী সাহেব তাঁর প্রস্তাবটি পেশ করলেন :

কুমিল্লা একাডেমীতে একাডেমীর স্টাফদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ চলছে। দুজন বিদেশি বিশেষজ্ঞও সেখানে অংশগ্রহণ করছেন। তিনি বললেন, আমি ওই ওয়ার্কশপে বক্তৃতা দিয়ে তাঁদের সহায়তা করতে পারি। আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশুনা করেছি, সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক দিকে এক আধটু যে পড়াশোনা করিনি সে কথাও সত্য নয়। তথাপি আমার চিন্তাভাবনার কেন্দ্ৰবিন্দু ছিল সাহিত্য। বিদেশি এক্সপার্টরা যেখানে অংশগ্রহণ করছেন, এরকম একটি ব্যাপারে আমার কি করার আছে সে ব্যাপারে নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে আমার সংশয় ছিল। কথা দীর্ঘ করব না। অবশেষে চাষী সাহেবের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, আমাকে শুধু সমাজতন্ত্রের ইতিহাস এবং তত্ত্বগত বিষয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। সপ্তাহে একটি বক্তৃতা আমাকে করতে হবে এবং প্রতি বক্তৃতার সম্মানী স্বরূপ একাডেমী আমাকে এক হাজার টাকা করে দেবেন।

এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করার সময়েই আমি জনাব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই । তিনি আমাকে পছন্দ করতেন এবং অবসর সময়ে নানা বিষয়ে আলাপ করতেন। এমনও ঘটেছে, কোন কোন রাতে না ঘুমিয়ে শুধু কথা বলেই পার করে দিয়েছি।

আমার সঙ্গে মাহবুবুল আলম চাষী সাহেবের নানা বিষয়ে বিস্তর গরমিল ছিল। আমি সিগারেট খেতাম। তিনি ধূমপান একেবারেই পছন্দ করতেন না। অল্পতেই আমি ক্ষেপে উঠতাম, তিনি সব সময়ে একটা সংযম রক্ষা করতেন। আনুষ্ঠানিক ভোজসভা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিরামিষ আহার করতেন। কৃষক সমাজের কিসে প্রকৃত উন্নতি হয় সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনাও করতেন। রাশিয়ান লেখক ঋষি টলষ্টয় তার অত্যন্ত প্রিয় লেখক ছিলেন। নিতান্ত নিরাড়ম্বর এবং সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। আমি এ ধারণায় উপনীত হয়েছিলাম যে, টলস্টয় পন্থা এবং গান্ধীবাদের মত এক ধরনের আদর্শবাদের প্রতি তাঁর যথেষ্ট ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল। সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটা অকৃত্রিম বলবান আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মধ্যে দেখেছি।

চাষী সাহেবের চরিত্রের আরেকটা দিকের প্রতিও আমার দৃষ্টি পড়েছে। তিনি অতিমাত্রায় আত্মসচেতন ছিলেন। সুপিরিয়র সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামের দরিদ্র জনগণের সেবা করতে এসেছেন, এ কথা তিনি ভুলতে পারতেন না। নানা আছিলায়, অন্যকেও সেকথা মনে করিয়ে দিতে ত্রুটি করতেন না। নিজের শক্তির ওপর তিনি অতিমাত্রায় আস্থাশীল ছিলেন। সামনাসামনি অন্যদের সঙ্গে কোন তর্কে প্রবৃত্ত হতেন না। তবে একথা ঠিক যে অন্যকোন ব্যক্তির মতামতকে তিনি ততটা দাম দিতেন, যতটা তার কাজে লাগে। উদ্দেশ্য গোপন রেখে নীরবে কাজ করে যাওয়ার ধৈর্য এবং অভিজ্ঞতা দুই-ই তার ছিল। ক্ষমতার প্রতি একটা একাগ্র আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে কাজ করতে দেখেছি।

একাডেমীর হোস্টেলের পেছনে একটা কক্ষে তিনি থাকতেন। একটা তক্তপোশ, একটা সাধারণ টেবিল, দুটো চেয়ারের বেশি আসবাবপত্র তাতে ছিল না। তিনি আটার রুটি এবং সবজি দিয়ে নাস্তা করতেন। দুপুরে ঐ একই ধরনের খাবার তিনি খেতেন। আমাকে যখন তখন ডেকে পাঠাতেন। কি কারণে বলতে পারব না, মানসিকভাবে তিনি আমার ওপর নির্ভর করতে চাইতেন। পরবর্তীতে অবশ্য এর একটা ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পেয়েছি। সেকথা পরে বলব।

প্রায় সময় তিনি তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে ট্রাংকল করে কথা বলতেন। যতদিনই সকালে বা বিকেলে আমি চাষী সাহেবের ঘরে গিয়েছি দেখেছি। তিনি তাহেরউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে ফোনে কথা বলছেন অথবা অপারেটরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, চেষ্টা করতে ঢাকায় ঠাকুর সাহেবকে পাওয়া যায় কিনা। স্বভাবতই আমার ধারণা হয়েছিল চাষী সাহেবের সঙ্গে ঠাকুর সাহেবের খুবই গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একবার তো আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আলম সাহেব আপনার সঙ্গে ঠাকুর সাহেবের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ তাই না। তিনি কি আপনার ছেলেবেলার বন্ধু? আমার কথা শুনে তিনি খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। জবাবে বলেছিলেন, তাহেরউদ্দিন ঠিক আমার ছেলেবেলার বন্ধু নয়। তবে জানেন কি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমি, তাহেরউদ্দিন এবং মোশতাক সাহেব একসঙ্গে ছিলাম।

তিনি টেবিল থেকে আনুমানিক ৬ ইঞ্চি x ৮ ইঞ্চি সাইজের বাঁধানো একটি ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, এই যে দেখুন। আমার, মুশতাক সাহেব এবং তাহেরউদ্দিনের ছবি । কলকাতাতে আমরা তিনজন একসঙ্গে থাকতাম এবং কাজ করতাম ।

মাঝখানে আমি কিছুদিনের জন্য ঢাকা এসেছিলাম। সপ্তাহখানেক পর একাডেমীতে ফিরি। সেই সন্ধ্যাবেলা ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে দেখি চেয়ার টেবিল একটাও নেই। সব ক্যান্টনমেন্টে ধার দেয়া হয়েছে। কোন এক কর্নেলের বিয়ে হচ্ছে। ঐ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী মোশতাক সাহেবও এসেছেন। ঐ ঘটনাটিকেও একটা নিত্যনৈমিত্তিক সাধারণ ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম ।

আমি ঠিক প্রফেশনাল সমাজবিজ্ঞানী ছিলাম না। ওয়ার্কশপে বক্তৃতা দেয়ার সময় প্রায় সময়ে একাডেমীর কোন কোন স্টাফ আমার বিরোধিতা করতেন। এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। আমার মত একজন, বলতে গেলে রাস্তার মানুষের বক্তব্য মেনে নিতে তাঁদের পেশাগত অহঙ্কারে বাধত। আমাকে বক্তৃতা করার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে, অনেকেই এটা পছন্দ করতেন না। চাষী সাহেব সব সময়ে আমাকে সমর্থন করতেন এবং আমার পক্ষ হয়ে কথা বলতেন। একাডেমীতে আমাকে পছন্দ করার মত যথেষ্ট বন্ধু-বান্ধবও ছিলেন। তারপরেও আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছিলাম, কিছু ভদ্রলোক মনে করছিলেন, আমি নেহায়েত অনধিকার চর্চা করছি। তাঁদের কথার মধ্যে যুক্তি ছিল। এই অস্বস্তিকর অযাচিতভাবে পাওয়া কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমার প্রাণ হাঁসফাঁস করছিল। একদিন মাহবুবুল আলম চাষীর কাছে আমার চলে আসার বিষয়টা উত্থাপন করি। কথা শুনে তিনি একটুখানি বিষন্ন হয়ে গেলেন এবং বললেন, আমি চলে এলে তিনি খুব একা অনুভব করবেন। একথা সেকথার ফাঁকে এটাও তিনি জানালেন যে, কুমিল্লা একাডেমীতে সারাজীবন কাটাবার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। তিনি বলতেন, একাডেমী আমার “Temporary hide out” (অর্থাৎ অস্থায়ী পালিয়ে থাকার জায়গা)। সেই সময়ে এই “টেম্পোরারি হাইড আউট” বলতে তিনি কি বোঝাতেন, তার তাৎপর্য আমি অনুধাবন করতে পারিনি। পরবর্তীকালে তিনি যখন খোন্দকার মুশতাকের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে ‘গণভবনে’ আসেন সমস্ত ব্যাপারটা তখনই আমি বুঝতে পারি। সে সম্পর্কে পরে বলব।

আরেকটা ঘটনা আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। দিন তারিখ মনে করতে পারব। না। বোধ করি জুলাই মাসের শেষের দিকে হবে। প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল ইকনমিক সেক্রেটারি ড. সাত্তার একাডেমীতে এসে হাজির । তিনি ছিলেন ক্ষমতার নিকটতম ব্যক্তি। তাঁর আগমন উপলক্ষে একাডেমীতে একটা চাপা উত্তেজনা। চাষী সাহেব একাডেমীর অফিসে সাত্তার সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম আমাকে তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি অঢেল ক্ষমতার অধিকারী, মুজিব সরকারের আমলাতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি যা বলছেন, দেখলাম সকলে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। আমি কোথাকার নাম পরিচয়হীন একজন আখ্যাত লেখক। কথায় কথায় প্রতিবাদ করছিলাম, এ জিনিসটা তার উপাদেয় হওয়ার কথা নয়।

ড. সাত্তারের কাছ থেকে জানতে পারলাম, একটি কি দুটি গ্রামে সমাজতন্ত্রের মডেল তৈরি করার জন্য শেখ সাহেব তাঁকে একটি ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছেন। এরকম একটি মডেল দাঁড় করানোর জন্য সাত্তার সাহেব চাঁদপুরে তাঁর আপনি গ্রামে “মেহেরপুর-পঞ্চগ্রাম সমবায় সমিতি” নামাঙ্কিত একটি সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এই প্রস্তাবিত সমাজতন্ত্রের মডেলটি কি ধরনের হবে তা পর্যালোচনা করার জন্য ড. সাত্তার ওই গ্রামেই একটি সিস্পোজিয়াম কিংবা ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছেন। একাডেমীর সমস্ত পদস্থ কর্মকর্তা, কুমিল্লার ডিসি, এডিসি, এসডিও এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বসম্পন্ন নেতা এবং কর্মীদের নিমন্ত্রণ করে তিনি মেহেরপুর-পঞ্চগ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন। আসলে নিমন্ত্রণ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। দেশের প্রেসিডেন্ট যাঁর ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন, তাঁকে খুশি করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলে আপনা থেকেই প্ৰস্তুত ছিলেন। সৌজন্যের খাতিরে সাত্তার সাহেব আমাকেও যেতে বলেছিলেন। তাঁর মুখের ওপর বলে দেই যে, আমি যাব না। তিনি যখন জিজ্ঞেস করলেন কেন আমি যেতে চাই না, বললাম, ক্ষমতার কাছের মানুষ সকলে আপনার কথা মেনে নেয় এটা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু আপনাকে খুশি না করলে আপনি কোনভাবে আমাকে বাধ্য করতে পারবেন না ।

ঐ মেহেরপুর-পঞ্চগ্রাম সমবায় সমিতির ওয়ার্কশপে বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের লোকেরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। কারা কারা ছিলেন, সঠিক মনে পড়ছে না। ব্রিটিশ হাই কমিশনার স্বয়ং অথবা হাই কমিশনের দায়িত্বশীল কোন কর্মচারী, অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার এবং কানাডিয়ান দূতাবাসের লোকজনও অংশ নিতে চাঁদপুর গিয়েছেন। মার্কিন দূতাবাসের কেউ ছিল কিনা এখন মনে করতে পারছিনে। আমার অনুমান ঐ ওয়ার্কশপের সঙ্গে শেখ মুজিব-হত্যাকাণ্ডের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল। কেন আমার মনে এই ধারণা জন্মে গিয়েছিল। সেকথা আমি পরে বলছি। মেহেরপুর-পঞ্চগ্রাম থেকে ফেরার পথে ড. সাত্তার আবার একাডেমীতে এসেছিলেন। তিনি কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট তাঁকে খুব স্নেহ এবং বিশ্বাস করেন। আর তিনিও প্রেসিডেন্টকে খুব শ্রদ্ধা করেন। শেখ সাহেব কাঁঠাল এবং ছোট মাছ খেতে পছন্দ করেন। তাই তিনি তাঁর জন্য খাজা কাঁঠাল এবং ছোট মাছ ভাজা করে নিয়ে যাচ্ছেন।

মেহেরপুর-পঞ্চগ্রাম সমবায় সমিতির কর্মীদের আমি কুমিল্লা একাডেমীতে ট্রেনিং নিতে দেখেছি। তাঁরা সংখ্যায় অনেক ছিলেন। ট্রেনিং গ্রহণকারী কর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন ড. সাত্তারের পিতা। সাদা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপিপরা প্ৰবীণ ভদ্ৰলোকের ছবিটি আজও আমার চোখে ভাসছে। সেই সময়ে আমাদের জাতীয় জীবনে বড় বড় ঘটনা ঘটছিল। শেখ সাহেব “কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ” সংক্ষেপে ‘বাকশাল’ গঠন করেছেন। বাকশালের উল্লেখযোগ্য সদস্যদের নামও সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হচ্ছিল। নির্বাচিত এমপি এবং সরকারি আমলাদের মধ্য থেকে লোক বেছে নিয়ে জেলা গভর্নরদের নামও ঘোষণা করা হয়ে গেছে। নতুন শাসন ব্যবস্থা নিয়ে সকলে কথাবার্তা বলছিল। একাডেমীতে ব্যস্ততা লক্ষ করা যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল একাডেমীতে জেলা গভর্নরদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

১৯৭৫ সালের দশই আগস্ট তারিখে সকালবেলা রেডিওতে খবর শুনলাম পূর্বের দিন কবি সিকান্দার আবু জাফর মারা গেছেন। জাফর সাহেবের সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তাঁর মৃত মুখ শেষবারের মত দেখার জন্য আমি একরকম ভেজা কাপড়েই ঢাকা চলে আসি। ঢাকা তো চলে এলাম, কিন্তু জাফর ভাইকে দেখতে পেলাম না। আগেই তাঁর দাফন হয়ে গেছে।

ঢাকায় এসে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি লক্ষ করি। নানান পেশার লোক দলে দলে মিছিল করে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে বাকশাল কর্মসূচির প্রতি আনুগত্য নিবেদন করছেন। শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, শ্রমিক এবং আরো নানা পেশার মানুষ মিছিল করে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য ছুটছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সকাল থেকে সন্ধে। জনস্রোতের বিরাম নেই, সকলেই বঙ্গভবন অভিমুখে ছুটছে। কে কার আগে যাবে প্রতিযোগিতা চলছে।

গোটা ব্যাপারটা আমার কাছে ভয়ানক বিদঘুটে মনে হয়। একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। প্রেসক্লাবে গিয়ে খুব সম্ভবত সাংবাদিক নির্মল সেনের সঙ্গে একদলীয় শাসনের প্রতি কাণ্ডজ্ঞানহীন আনুগত্য ঘোষণার কুফল সম্পর্কে কথাবার্তা বলি। আমার সঙ্গে কারও কোন সম্পর্ক ছিল না। বাকশাল নীতির বিরোধিতা করতে হবে এরকম কোন পূর্ব-পরিকল্পনাও ছিল না। আপনাআপনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমার মুখ থেকে কথা বেরিয়ে আসছিল। শুধু প্রেসক্লাব নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্জাক সাহেবের বাসায় গিয়ে নিঃসঙ্কোচে কথাবার্তা বলি। এখন নাম মনে পড়ছে না, অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি।

পনেরই আগস্ট প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার তোড়জোড় চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল চুনকাম করা হচ্ছে, রাস্তায় পিচ ঢালা হচ্ছে। সর্বত্র একটা আসন্ন উৎসবের আমেজ। খবর শোনা যাচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সমস্ত শিক্ষক বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য সই করে ফেলেছেন । প্রেসিডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে সকলে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করবেন। আরো শুনতে পাচ্ছিলাম, কোন কোন সাংবাদিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আট-দশজন শিক্ষক বাকশালে যোগ দিতে শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করেছেন।

আমি কোন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলাম না। আমি শুধু লিখতাম এবং কথা বলতাম, সব সময়ে অসংকোচে কথা বলতাম। আমি রাতে থাকিব কোথায়, পরের বেলা খাবার জোটাব কি করে তারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। তবু বিপদে পড়ে গেলাম। কি করে প্রচারিত হয়ে গেছে যে আমি শিক্ষক সাংবাদিকদের যোগ না দেয়ার জন্য প্রচার কার্য চালাচ্ছি। এই খবরটা শেখ সাহেবের বড় ছেলে শেখ কামালের কানে যথারীতি পৌঁছায়। শুনতে পেলাম তিনি আমাকে উচিত শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আমার অবস্থা দাঁড়াল ফাঁদে ধরা পশুর মত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন বন্ধু-বান্ধবের বাসায় গিয়ে একটা নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। একজন তো বলেই দিলেন, ভাই আমরা বউ ছেলে নিয়ে বসবাস করি । তোমাকে বাসায় বসতে দিতে পারব না। তোমার নামে নানা গুজব । তোমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে জানলে বিপদে পড়তে পারি।

আমি চৌদ্দই আগস্ট সন্ধ্যাবেলার কথা বলছি। একজন ভগ্নিস্থানীয়া হাউজ টিউটরের বাসায় গিয়ে হাজির হই। আমার বিশ্বাস ছিল তাঁর কিছু উপকার করেছি। আমি খাইনি এবং কিনে খাওয়ার পয়সা নেই। লাজশরমের মাথা খেয়ে তাকে কিছু খাবার দিতে বলি। মহিলা পলিথিনের ব্যাগে কিছু মোয়া দিয়ে বললেন, ছফা ভাই এগুলো পথে হাঁটতে হাঁটতে আপনি খেয়ে নেবেন। আপনাকে বসতে দিতে পারব না।

তার বাসার বাইরে এসে কি ধরনের বিপদে পড়েছি পরিস্থিতিটা আঁচ করতে চেষ্টা করলাম। বলতে ভুলে গেছি। কার্জন হলে না কোথায় দুটো বোমা ফুটেছে। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সেই সময়ে আমার বন্ধু অরুণ মৈত্র আমার সঙ্গে ছিলেন। অরুণ ‘ইস্টল্যান্ড’ নামে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থাতে কাজ করতেন। অরুণের সঙ্গে আমি হেঁটে হেঁটে বিলাকা বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি আসি। অরুণ আমাকে বললেন, সময়টা আপনার জন্য অনুকুল নয়। আপনি কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যান। পরামর্শটা দিয়ে অরুণ বাসায় চলে গেলেন ।

উদ্দেশ্যবিহীনভাবে আমি বিলাকা বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওমা কিছু দূর যেতেই দেখি একখানা খোলা জিপে সাঙ্গাপাঙ্গসহ শেখ কামাল। একজন দীর্ঘদেহী যুবক কামালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, দেখ কামাল ভাই, আহমদ ছফা যাচ্ছে। কামাল নির্দেশ দিলেন হারামজাদাকে ধরে নিয়ে আয়। আমি প্রাণভয়ে দৌড়ে নিউ মার্কেটের কাঁচাবাজারের ভেতর ঢুকে পড়ি। যদি কোনদিন স্মৃতিকথা লিখতে হয়, এই পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিশদ করে বর্ণনা করব। বর্তমান মুহুর্তে নিজের বিষয়ে অধিক কিছু বলব না। তা হলে যে বিষয়টা আমি বিবৃত করছি, তার ওপর সুবিচার করা সম্ভব হবে না। ওই চৌদ্দই আগস্ট রাতে আমি সোবহানবাগের বিপরীতে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের হোষ্টেলে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলাম। ঐ হোস্টেলে থাকতেন আমার এক বন্ধু। জাসদ দলটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাঁর নাম ছিল সিরাজদ্দৌলা চৌধুরী। লম্বা চওড়া সুঠাম চেহারার যুবক। তাঁর একটা পা ট্রেন দুর্ঘটনায় কাটা পড়েছিল। তাই তাঁকে নকল পা ব্যবহার করতে হত। তিনি ছিলেন “বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের” ইনস্ট্রাক্টর। রোটারি ক্লাব থেকে একটি বৃত্তি পেয়েছেন সম্প্রতি এবং আমেরিকায় যাওয়ার প্রতীক্ষা করছিলেন।

সোবহানবাগস্থ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার থেকে শেখ সাহেবের বত্রিশ নম্বরের বাড়ির দূরত্ব কয়েক শ গজের অধিক হবে না। সে রাত্রের শেষভাগে আচমকা প্রচণ্ড গুলিগোলার শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। একটানা গুলিগোলা চলছিল। আমরা ধারণা করছিলাম, শেখ সাহেব যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে না পারেন, সেজন্য জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একটি সুইসাইড স্কোয়াড পাঠিয়েছে। তারাই মধ্যরাতে গুলিগোলা, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি ছুঁড়ছে। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে ভোর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি অন্যান্যদের সঙ্গে কর্নেল শাফায়েত জামিলের মৃত্যুদৃশ্যটাও দেখেছি। বর্তমান লেখায় তার উল্লেখ করব না। ভবিষ্যতে যদি কোনদিন সম্ভব হয় তবে । সকালবেলা রেডিওতে মেজর ডালিমের কণ্ঠস্বর শুনে জানতে পারলাম, শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন এবং খোন্দকার মুশতাক আহমদ শাসনভার গ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে কি ঘটে জানার জন্য রেডিওর কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু বেলা হলেই রেডিও জানাল তিন বাহিনী প্রধান এবং বিডিআর, পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তারা মুশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।

পনেরই আগষ্টের দিনটি ছিল শুক্রবার। কারফিউ ছিল কিনা মনে করতে পারছিনে। পথে বের হওয়া নিরাপদ মনে হলে দুপুরবেলা আমি হেঁটে হেঁটে মুহম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে ড. আখলাকুর রহমানের বাড়িতে হাজির হই। ড. আখলাক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সে সূত্রে আমার সঙ্গেও তার কিছু পরিমাণ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। দেশে কি হতে যাচ্ছে সেটা জানার জন্যই আমি ড. আখলাকুর রহমানের বাড়িতে হাজির হই। তাঁর বাড়ির গেটে গিয়ে দেখি প্ৰায় বিশ-বাইশজন সামরিক বাহিনীর লোক গার্ড দিচ্ছে। আমাকে গেট ঠেলে বাড়িতে ঢুকতে দেখে চার-পাঁচটা স্টেনগান আমার দিকে বাগিয়ে ধরে জোয়ানেরা থামতে বলল। আমার তো হাসি পেয়ে গেল। আমাকে শেষ করে দেয়ার জন্য রিভলবারের একটা গুলিই তো যথেষ্ট । এত উদ্যমের অপচয় কেন । সে সময়ে ড. আখলাকুর রহমান বেরিয়ে এসে আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। ওখানেও দেখি সামরিক বাহিনীর লোকে ভর্তি। ওই পনেরই আগস্ট তারিখেই ড. আখলাকের বাড়িতে ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন, একজন প্রত্যয়দীপ্ত ভদ্রলোকের সঙ্গে আখলাক সাহেব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নাম কর্নেল আবু তাহের। সেই কর্নেল তাহেরের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা । তারপরে আর কোনদিনই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। দু-একদিন পরে ড. আখলাককে মিসেস আখলাকের সঙ্গে বলাবলি করতে শুনেছি, সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাকে দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। আখলাক সাহেব রাজি হননি। আমার মনে কিন্তু একটা ভিন্ন ধরনের চিন্তার উদয় হয়েছিল। সামরিক বাহিনীর লোকেরা শেখ মুজিবের বিরোধী শিবিরের লোকজনের কাছে টোপ ঝুলিয়ে রেখে নিজের অবস্থান সংহত করে নিচ্ছিল। শেখ মুজিবকে হত্যা করে অন্য কাউকে প্রেসিডেন্ট বানানোর ইচ্ছা তাদের থাকার কথা নয়। যাহোক এটা আমার অনুমান মাত্র।

ষোল তারিখ বেলা ১০টার দিকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে যাই। কুমিল্লা একাডেমীতে যাওয়ার পূর্বে আমি এই ছাত্রাবাসের ২০৬ নম্বর কক্ষে থাকতাম। গেটের কাছে আমার সঙ্গে ইতিহাসের শিক্ষক আহমেদ কামালের সঙ্গে দেখা । তিনি তখন আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে থাকতেন। কিনা মনে করতে পারছিনে। কামাল জানালেন, তাঁরা মনে করেছিলেন পূর্বরাতে আমাকে খুন করা হয়েছে। আরো জানালেন প্রফেসর রাজ্জাক হাসপাতাল এবং মর্গে খোঁজখবর করেছেন। রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে তারপরে দেখা করতে যাই । তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা খেয়াল নেই। দুপুরবেলার খাবারটা আজিজুল হক সাহেবের সঙ্গে খাই। আগেই বলেছি, তিনি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষিকা হুসনে আরা হকের স্বামী। থাকতেন “উদয়ন স্কুলের” দক্ষিণে বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফ কোয়ার্টার্সে। সেই বাড়িতে তখন সন্ত্রীক গ্যাসকার্টও ছিলেন। মিসেস হক এবং জনাব আজিজুল হক আমাকে বেপরোয়াভাবে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে বারণ করেন এবং গ্যাসকার্টকে অনুরোধ করেন আমাকে যেন তাঁর গাড়িতে করে যেখানে যেতে চাই নামিয়ে দেন। গ্যাসকার্টের মাইক্রোবাসে উঠে বসলে তিনি জানতে চান, আমি কোথায় যাব। আমি মোহাম্মদপুরে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করলাম। গ্যাসকার্টের বৌ ছিলেন জাতে আইরিশ। তিনি গাড়িতে তর্ক জুড়ে দিলেন। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে একথা তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেন না। আমি বললাম, “শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।” ভদ্রমহিলা এক রকম চিৎকার করেই বলতে আরম্ভ করলেন, “লুক আই ডু নট বিলিভ দ্যাট হি ইজ কিলড।” বুঝতে পারলাম এ বিষয়ে মহিলার সঙ্গে অধিক বলা নিরর্থক।

গ্যাসকার্ট মিরপুর রোড ধরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বত্ৰিশ নম্বরের সামনে তিতাস কনফেকশনারি দোকানটি খোলা দেখে তিনি বললেন, বিকেল থেকেই তো কারফিউ শুরু হবে। আমি এই দোকান থেকে পাউরুটি এবং অন্যান্য কিছু জিনিস কিনে নেই। গাড়ি থামিয়েই তিনি দোকানের মধ্যে ঢুকে গেলেন। আমি আর মিসেস গ্যাসকার্ট গাড়িতে বসে কথা বলছিলাম। তখনো মহিলা আউড়ে যাচ্ছিলেন, “আই ডু নট বিলিভ দ্যাট শেখ গট কিলড।” আমি জানালার কাচের ভেতর দিয়ে দেখি শেখ মুজিবের বত্ৰিশ নম্বরের বাড়ির দিক থেকে এসে একটি মিলিটারি ট্রাক থামাল। ট্রাক বোঝাই জিনিস ঢাকা দেয়ার জন্যে হলুদ রঙের ত্রিপল চাপানো হয়েছে। হঠাৎ করে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় বলে দিল এই ট্রাকে করে শেখ মুজিবের লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি ভাল করে তাকিয়ে দেখি পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দেখা যাচ্ছে। অত দীর্ঘ বুড়ো আঙুল শেখ মুজিব ছাড়া আর কারো হতে পারে না। আমি মিসেস গ্যাসকার্টকে ডেকে বললাম, “ইউ ডু নট বিলিভ শেখ গট কিলড, লুক হিজ টো বিজিবল আন্ডার দ্যা ত্রিপল অন দিজ ট্রাক।” ভদ্রমহিলা ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন। তারপর আর কোন কথা বললেন না। তার চোখ দিয়ে বড় বড় পানির ফোটা নামতে লাগল। সেদিন সন্ধের টিভিতে এলেন ড. সাত্তার। আমাদের ছেলেরা এই মহান দায়িত্ব পালন করে নিরাপদে ফিরে আসতে পারার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলেন। ড. সাত্তারকে টেলিভিশনে একথা বলতে শুনে আমি তো বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম। আমি নিজের কানে শুনেছি তিনি বলেছেন, “শেখ মুজিব তাঁকে পুত্রের মত স্নেহ করেন, আর তিনিও তাঁকে পিতার মত ভক্তি করেন।”

শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর আমি আর কুমিল্লা ফেরত যাইনি। সবাই আমাকে পরামর্শ দিলেন, আমি যেন ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে আমার স্কলারশিপটা ফেরত দিতে বলি। আমি একটু ইতস্তত করেছিলাম। কারণ স্কলারশিপটা আমি স্বেচ্ছায় রাগ করে ছেড়ে দিয়েছি। আবার ফেরত চাইতে গেলে কেমন দেখায়। কেউ কেউ আমাকে বললেন, তুমি মতিন চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা কর। তিনি অবশ্যই ফেরত দেবেন। আমি মতিন চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। মতিন চৌধুরীর পূর্বের তেজ-বীৰ্য কিছুই নেই। একেবারে চুপসে গেছেন। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। এক কথায় তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্রোকেন মানুষ। আমার স্কলারশিপটা ফেরত দিতে নীতিগতভাবে তাঁর আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ব্যাপারে আর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আমি নিরাশ হয়ে ফিরে এলাম। তখন বন্ধু-বান্ধবদের কেউ কেউ আমাকে বললেন, মতিন চৌধুরীর সাধ্য নেই তোমার স্কলারশিপ ফেরত না দেয়। তুমি মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে দেখা কর। তিনি বললেন মতিন চৌধুরী অবশ্যই স্কলারশিপ ফেরত দেবেন। এখানে বলে রাখা ভাল, মুশতাক প্রেসিডেন্ট হওয়ার অব্যবহিত পরেই চাষী সাহেব তার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে বঙ্গভবনে ফিরে এসেছেন।

অগত্যা আমি মাহবুবুল আলম চাষী সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর পিএ টেলিফোন ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গেই চাষী সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনলাম। এতদিন বাদে আপনি যোগাযোগ করছেন। আশা করেছিলাম আগেই টেলিফোন করবেন।

আমি বঙ্গভবনে গেলাম। হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও চাষী সাহেব আমার সঙ্গে তৎক্ষণাৎ দেখা করলেন। ৬×৮ ইঞ্চি সাইজের বাঁধানো ফটোগ্রাফটি আমাকে আবার দেখিয়ে বললেন, আপনার মনে আছে, একাডেমীতে বলেছিলাম, আমি, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং মুশতাক সাহেব কলকাতায় একসঙ্গে ছিলাম। বলেছিলাম না একাডেমী আমার ‘টেম্পোরারি হাইড আউট।’ দেখতেই তো পাচ্ছেন আমরা আবার তিনজন বঙ্গভবনে একসঙ্গে কাজ করছি। চাষী সাহেব টেলিফোন করে অবিলম্বে মতিন চৌধুরী সাহেবকে আমার স্কলারশিপ ফেরত দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং মতিন চৌধুরী সে কথা রক্ষা করেছিলেন।

মাহবুবুল আলম চাষীকে আমি সর্বাংশে না হলেও অনেকখানি পছন্দ করতাম। তাঁর চরিত্রের প্রশংসা করার মত অনেক গুণ ছিল । তিনি জীবনে আমার অনেক উপকার করেছেন। তাঁর ঋণ আমার পক্ষে কোনদিন শোধ করা সম্ভব হবে না। এ পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে যেসব কথা বলেছি সব সত্য বলেছি। একটি কথাও বানিয়ে বলিনি। এই বিষয়টা নিয়ে আমি দীর্ঘদিন চিন্তা করেছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে আমি সুখে ছিলাম না। বর্তমানেও আমি আওয়ামী লীগ সমর্থক নই। তবু শেখ হত্যার ব্যাপারটি আমার জাতীয় জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভবিষ্যতের গবেষকদের কাছে আমার দেয়া তথ্যসমূহ বিশেষ কাজে আসবে মনে করে এ রচনাটি লিখলাম।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

আযানের পূর্ণ অর্থ

FB_IMG_1502477883614

আযানের পূর্ণ অর্থ
ইসলাম ডেস্ক: মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকেরই আযানের পূর্ণ অর্থ জেনে রাখা উচিত হলেও অনেকেই তা জানেন না। তাই পবিত্র আযানের অর্থ না জানা সেই সকল মুসলমান ভাই ও বোনদের জন্য নিচে আযানের পূর্ণ অর্থ বর্ণনা করা হলো-

الله أكبر، الله أكبر،

الله أكبر، الله أكبر،

আল্লাহু আক্বার, আল্লাহু আক্বার

আল্লাহু আক্বার, আল্লাহু আক্বার

অর্থ : আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

أشهد أن لاإله إلاالله، أشهد أن لاإله إلاالله،

أشهد أن لاإله إلاالله، أشهد أن لاإله إلاالله،

আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্, আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,

আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্, আশহাদু আল্লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ্,

অর্থ

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

أشهد أنَّ محمدًا رَسُوْلُ اللهِ،

أشْهَدُ أنَّ محمداً رسول الله،

আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ্, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ্,

আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ্, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ্,

অর্থ

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল।

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল।

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল।

আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসুল।

حيَّ عَلىَ الصَّلاَةِ،

حي على الصلاة،

হাইয়্যা আলাস্সালাহ্, হাইয়্যা আলাস্সালাহ,

অর্থ : এসো নামাজের দিকে, এসো নামাজের দিকে।

حي على الفَلاَحِ،

حي على الفلاح

হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ, হাইয়্যা আলাল্ ফালাহ,

অর্থ : এসো কল্যাণের পথে, এসো কল্যাণের পথে।

الله أكبر، الله أكبر،

আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।

অর্থ : আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

لاإله إلا الله

লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ্।

অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই।

ফজরের আজানে অতিরিক্ত বলা হয়‘আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম, আস সলাতু খাইরুম মিনান নাউম। অর্থ : ঘুম থেকে নামাজ উত্তম, ঘুম থেকে নামাজ উত্তম।

Posted in Uncategorized | Leave a comment

আজানের ফজিলত

FB_IMG_1502477883614

আজানের ফজিলত :

হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যখন নামাজের আজান দেয়া হয়, তখন শয়তান বায়ু ছাড়তে ছাড়তে দৌড়িয়ে বহু দূর চলে যায়, যেন আজানের আওয়াজ তার কানে প্রবেশ না করে। আজান শেষ হলে লোকালয়ে আবার ফিরে আসে। যখন ইকামত বলা হয় তখনো এরূপ দৌড়ে পালায়। ইকামত শেষ হলে পুনরায় এসে নামাজরত ব্যক্তিদের মনে নানা অসওয়াসা সৃষ্টি করে তাদের দিলে এদিক-সেদিক থেকে নানা কথা টেনে আনতে থাকে, যেসব কথা তাদের স্মরণেও ছিল না। এরূপে শয়তান নামাজি ব্যক্তিকে নানা কথায় ফেলে তার নামাজ ভুলিয়ে ফেলে। এমনকি কত রাকাত পড়েছে তাও স্মরণ থাকে না (বুখারি)।

আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, মানুষ যদি জানত আজান দেয়ার মাহাত্ম্য ও ফজিলত কী, তবে লটারি করে হলেও আজান দেয়ার সুযোগ তালাশ করত (বুখারি)। সাহাবিদের যুগে একবার এক ঘটনা ঘটেছিল, আজান দেয়ার প্রার্থী অনেক হলো, এমনকি উপস্থিত সাহাবি সায়াদ রা: তাদের মধ্যে লটারি করতে বাধ্য হলেন।

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, যে সওয়াবের কাজ মনে করে সাত বছর আজান দেবে তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হবে (তিরমিজি)।

মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ইবনে নুমাইর রহ: তালহা ইবনে ইয়াহইয়ার পিতৃব্য থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন আমি এক সময় মুয়াবিয়া রা: ইবনে আবি সুফিয়ানের কাছে ছিলাম। মুয়াজ্জিন এসে তাকে নামাজের জন্য আহ্বান করলেন, মুয়াবিয়া রা: বললেন, আমি হুজুরে পাক সা:কে বলতে শুনেছি, রোজ কিয়ামতে মুয়াজ্জিনের গ্রিবাদেশ সর্বাপেক্ষা লম্বা হবে (মুসলিম)।

আবদুর রহমান ইবনে আবু সাসা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু সায়িদ রা: আমাকে বলেছেন: যখন তুমি জঙ্গলে থাকবে তখন তুমি উচ্চৎস্বরে আজান দেবে। কেননা আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি; জিন-ইনসান, বৃক্ষলতা ও অচেতন পাথর যে এ আজান শুনবে, সে তার জন্য কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দেবে (ইবনে মাজা)।

আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:কে বলতে শুনেছি- মুয়াজ্জিনের আজানের শব্দ যত দূর পৌঁছাবে, সে দূরত্বের পরিমাণ তাকে মাফ করা হবে এবং জলস্থলের সব কিছুই তার জন্য মাগফিরাত কামনা করবে (ইবনে মাজা)।

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি সওয়াব লাভের আশায় সাত বছর আজান দেয় আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরোয়ানা লিখে দেবেন (ইবনে মাজা)।

ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি বারো বছর আজান দেয় তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়, আর প্রত্যেক আজানের বিনিময়ে তার জন্য ষাট নেকি লেখা হয় এবং প্রত্যেক ইকামতের জন্য ত্রিশ নেকি লেখা হয় (ইবনে মাজা)।

যাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আজান শুনে বলে, ‘আল্লাহুম্মা রাব্বা … ইন্নাকা লা তুখলিফুল মিয়াদ।’ তার জন্য কিয়ামতের দিন আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যাবে (বুখারি, আবু দাউদ)।
সূত্র নয়া দিগন্ত

Posted in Uncategorized | Leave a comment

আজানের জবাবের গুরুত্ব

FB_IMG_1502477883614

 

আজানের জবাবের গুরুত্ব

মাওলানা মাহমূদুল হাসান

আজানের জবাব দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি এবাদত। আজান যখন হয় তখন কোরআন তেলাওয়াত বন্ধেরও নির্দেশ এসেছে।
হাদিস শরিফে এসেছে, যে ব্যক্তি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত আজানের জবাব দেবে, আজানের পর দুরূদ ও দোয়া পড়বে, আল্লাহপাক তাকে দুনিয়ার জীবনে পরিশুদ্ধ করবেন এবং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাল কেয়ামতের ময়দানে সুপারিশ করে তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। একজন মুসলমানের জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্যের বস্তু আর কিছুই নেই। দুনিয়ার জীবন এক দিন শেষ হবেই কিন্তু আখেরাতের জীবন চিরস্থায়ী। এই জীবনের সফলতার জন্য আজানের পর জবাব দেওয়া খুবই সহজ বিষয়। দ্বীন ইসলাম খুবই সহজ বিষয়, কিন্তু শয়তান আমাদের এ কাজ করতে দেয় না। অনেক মসজিদে দেখা যায়, মানুষ দল বেঁধে আলাপ করছে, কিন্তু আজানের জবাব দেয় না। হাদিস শরিফে এসেছে, মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে যখন আজানের ধ্বনি ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারিত হয় তখন শয়তান পেছনের রাস্তা দিয়ে পালানোর জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। আজান শেষ হওয়ার পর যখন নামাজের সময় হয় তখন আবার শয়তান চলে আসে। এ জন্যই হাদিসে বলা হয়েছে, যখন নামাজের জন্য দাঁড়াও তখন একজন অপরজনের গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়াও, যাতে দুজনের ফাঁকে শয়তান দাঁড়াতে না পারে।

হাদিসের মর্ম না বোঝার কারণে অনেকে প্রশ্ন করে যে, শয়তানকে তো দেখা যায় না, তাহলে শয়তান যে ফাঁকে দাঁড়ায় তা বোঝা গেল কীভাবে? যারা এমন প্রশ্ন করেন তারা আসলে হাদিস বুঝতে পারেননি। হাদিসের মর্ম হলো, শয়তান বাস্তবিকই পা রেখে উভয়ের মধ্যখানে দাঁড়ায় না, তবে সে ওই দুই ব্যক্তির অন্তরের খুশুখুযু বিনষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়, যারা দাঁড়ানো অবস্থায় মাঝখানে ফাঁক রাখে। জায়গা ফাঁক রেখে দাঁড়ানো গুনাহের কাজ। আর এই গোনাহের কারণেই শয়তান প্রশ্রয় পেয়ে মানুষের অন্তরে বাইরের চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়। আজান শুনলে শয়তান পালায় আর নামাজের সময় হলে শয়তান আসে, এর দ্বারা বাহ্যিকভাবে বুঝা যায় যে, নামাজের চেয়ে আজানের মর্যাদা বেশি। আসলে অনেক সময় ছোট জিনিস স্থান-কালের ভিন্নতায় দামি হয়ে যায়। যেমন লবণের কথা চিন্তা করুন। এটি অতি অল্প মূল্যের জিনিস, অথচ তাকে ছাড়া হাজার হাজার টাকা দামের পাকানো গোশতেরও কোনো মর্যাদা থাকে না। তবে আজান না দিলেও নামাজ হয়ে যায়, কিন্তু আজান দ্বারা যে মহা ফায়দা ও ফজিলত অর্জন করা যায় তা থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

আল্লাহপাক আজানের জবাব দেওয়া বান্দার জন্য সুন্নত করেছেন। তার কারণ হলো- জবাব দিলে বান্দার উপকারে আসে। মুয়াজ্জিনের আজানের আওয়াজ যতদূর যাবে ততদূরের সবকিছুই কাল কেয়ামতের ময়দানে মুয়াজ্জিনের জন্য সাক্ষ্য দেবে। মুয়াজ্জিনের আজানে সাড়া দিয়ে যে ব্যক্তি নামাজ পড়তে আসবে এবং তার যত সওয়াব হবে মুয়াজ্জিনেরও সেই পরিমাণ সওয়াব হবে। মুয়াজ্জিন আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহর ডাকের জবাব দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু মানুষ যেহেতু দুনিয়ার নানা কাজে মশগুল থাকে তাই আল্লাহপাক আজানের জবাব দেওয়াকে ওয়াজিব বা ফরজ করেননি। বস্তুত সাক্ষ্য দেওয়া সবারই কাজ নয়। অবিশ্বস্ত ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হয় না। যার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে তার প্রিয় হতে হবে আর যিনি দেবেন তাকেও প্রিয় হতে হবে। যদি উভয়েই প্রিয় হয় তাহলে আল্লাহপাকও তাদের সাক্ষ্য প্রিয় হিসেবে গ্রহণ করবেন। আর যদি প্রিয় না হয় তাহলে তাদের সাক্ষ্যও আল্লাহপাকের দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। যে ব্যক্তি নিয়মিত আজানের জবাব দিতে থাকবে সে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বমহূর্তে হলেও গুনাহমুক্ত হবে এবং মৃত্যুর পর আল্লাহপাক তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবেন।

লেখক : খতিব, গুলশান সেন্ট্রাল জামে মসজিদ, ঢাকা।

Posted in Uncategorized | Leave a comment